প্রায় সাড়ে চার হাজার বছরের পুরোনো এক আধুনিক শহর : মহেঞ্জোদারো

প্রায় সাড়ে চার হাজার বছরের পুরোনো এক আধুনিক শহর : মহেঞ্জোদারো

আজ থেকে দেড়শো বছর পূর্বে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে রেললাইন স্থাপনের কাজ করতে গিয়ে সেখানে আবিষ্কার হয় পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা গুলোর একটি।  নাম না জানা এ শহরকে ‘মৃতের স্তুপ’ বা ‘মাহেঞ্জোদারো’ বলেই ডাকা হয়। আবিষ্কারের পর থেকে এ শহর নিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদদের  মধ্যে নানান জল্পনা কল্পনা শুরু হয়, এমন এমন তথ্য আবিষ্কার হতে থাকে, যা রীতিমত আধুনিক চলমান সভ্যতায় বিষ্ময়কর। চলুন জেনে নেই  দক্ষিণ এশিয়ার রোমাঞ্চকর এই মহেঞ্জোদারো সম্পর্কে।

অবাক করা বিষয় হলেও সত্য মহেঞ্জোদারো শহরটি বর্তমান বিশ্বের আধুনিক শহরগুলোর মতোই একটি শহর। অথচ পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন একটি শহরটি আজ থেকে প্রায় প্রায় চার হাজার ছয়’শ বছরের পুরনো। তাদেরও ছিল ইটের বাড়ি, সান বাঁধানো পুকুর এবং পয়ঃপ্রণালীর ব্যবস্থা,  কিন্তু বর্তমানে মহেঞ্জোদারো একটি ধ্বংসস্তূপ যেটি লিপিবদ্ধ হয়েছে ইতিহাসের পাতায়। মহেঞ্জোদারো ছিলো হরপ্পা সভ্যতার প্রধান শহর। যেটা বর্তমানে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় সিন্ধু নদের তীরে অবস্থিত। ৪ হাজার ৬০০ বছরের পুরানো এই শহরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল প্রায় দেড়শ বছর পূর্বে। মহেঞ্জোদারো আসল নাম ঠিক করে এখনো প্রত্নতত্ত্ববিদরা বলতে পারেন নি। মহেঞ্জোদারো  শব্দের অর্থ মৃতের স্তুপ বা পাহাড়। তবে মহেঞ্জোদারোর পুরনো শিলা দেখে পুরাতাত্ত্বিকরা একটি দ্রাবিড় নাম খুঁজে পান, সেটি হল কুক্কুতার্মা (Kukkutarma)।  এই শহর সম্পর্কে মানুষ খুব কমই জানে তবে যতটুকু জানে ততটুকু বেশ বিস্ময়কর! ইউনেস্কো এ শহরটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে ১৯৮০ সালে।

১৮৫৬ সালে একজন ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার এই অঞ্চলে রেললাইন স্থাপনের কাজ করছিলেন। সেসময় মাটির তলায় তিনি পুরানো ইট দেখতে পান, যেগুলো দেখতে অনেকটা বর্তমান সময়ের ইটের মতই। তখন একজন স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে জানা যায় এখানকার সকল বাড়ি এই ইটের তৈরি যা মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায়। তখন সেই ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার বুঝতে পারেন এগুলো সাধারণ কোনো ইট নয়। এই জায়গায় লুকিয়ে আছে কোনো প্রাচীন সভ্যতা। সিন্ধু নদের তীরে গড়ে ওঠা এই শহর সম্পর্কে এই ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ারই প্রথম জানতে পেরেছিলেন। তারপর দীর্ঘ সময় পাড়ি দিয়ে ১৯২২ সালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহেঞ্জোদারো পুনরাবিষ্কার করেন, ৪০ বছরের বেশি সময় লেগেছিল এই শহরকে আবিষ্কার করতে। ১৯৩০ সালে স্যার জন মার্শাল এর নেতৃত্বে ব্যাপক খননকার্য চালানো হয়।

মহেঞ্জোদারোতে বসবাসরত তখনকার মানুষের উন্নত জীবনাচরণ সবচেয়ে বেশি বিস্ময়কর। এ শহরকে নিয়ে যতই গবেষণা হচ্ছে, এ শহর যেন ততই তার তৎকালীন আধুনিক রূপ প্রকাশ করছে।  মহেঞ্জোদারো তখনকার সময় অন্যান্য সভ্যতা থেকে অনেক বেশি বিকশিত এবং সমৃদ্ধ ছিল। এই শহর প্রায় ৬০০ একর জমির উপর বিস্তৃত ছিল যেটা তখনকার সময় বেশ বড় আয়তনের। এখনকার ধ্বংসস্তূপ থেকে জানা যায় শহরে প্রবেশ করার জন্য একটা বড় গেট ছিল। এছাড়াও এখানে এমন কয়েকটি বড় বাড়ি আছে যা তিনতলা পর্যন্ত উঁচু। এখানে বাড়ি বানানোর জন্য যে ইট ব্যবহার করা হয়েছিল তা কোনো সাধারণ ইট ছিল না বরং ওয়াটার প্রুফ ইট ছিল। ধারণা করা হয় পৃথিবীতে প্রথম পাত কুয়া তৈরি করা হয়েছিলো হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের দ্বারা। এই শহরে ৭০০ এর বেশি পাত কুয়ার সন্ধান মিলেছে। সিন্ধু নদের তীরে অবস্থিত মহেঞ্জোদারো সবচেয়ে পুরনো পরিকল্পিত একটি শহর। এখানকার রাস্তাগুলো এলোপাথাড়ি তৈরি হয়নি বরং প্রত্যেকটি রাস্তারই একটি নির্দিষ্ট ধারা এবং মাপ ছিল। এ থেকে ধারণা করা হয় মহেঞ্জোদারোর মানুষদের গণিতশাস্ত্রে বেশ ভালো জ্ঞান ছিল।

এ শহরের আধুনিকতার আরেকটি অন্যতম আবিষ্কার এই শহরের তৎকালীন পয়ঃপ্রণালী। মহেঞ্জোদারো কোনো সাধারণ শহর ছিল না বরং এই শহরে বড় বড় ঘর, পরিকল্পিত রাস্তা ও কুয়া থাকার প্রমাণ মিলেছে। আরো অবাক করার মতো তথ্য হলো এই শহরে নোংরা জল বের হওয়ার জন্য ড্রেইনেজ ব্যবস্থা ছিল অর্থাৎ বড় বড় নির্দিষ্ট সংখ্যক ড্রেন ছিল যা সেসময় হিসেবে বেশ অকল্পনীয় একটু ব্যপার। মহেঞ্জোদারোর মানুষেরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে এত সজাগ ছিল যেটা হয়তো আজকের যুগের মানুষেরও নেই। এমনকি মহেঞ্জোদারো শহরে বাথরুম বব্যস্থারও প্রমাণ মিলেছে।

মহেঞ্জোদারোর এক বড় আকর্ষণ ছিল এর মহা স্নানাগার। নগরীর ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত গ্রেট বাথ নামক স্থাপনাটি। গবেষকদের ধারণা ধর্মীয় পরিশুদ্ধির জন্য এই জায়গায় গোসল করতে আসতো পুণ্যার্থীরা। পুলের জল যাতে বেরিয়ে না যায় তাই সেদিকেও খেয়াল ছিল মহেঞ্জোদারোর বাসিন্দাদের।

মহেঞ্জোদারো নদী কেন্দ্রিক সভ্যতা। নদীর আশেপাশের মাটির উর্বরতার জন্য এখানকার মানুষ চাষাবাদ করতে পারতো। উদ্বৃত খাদ্যশস্য মজুদ করে রাখার জন্য ছিল বিশেষ ব্যবস্থা। শস্যের আদান-প্রদানের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ছিল স্থাপনাটির পাশে। এমনকি খাদ্য শস্য যেন অনেকদিন পর্যন্ত ভালো থাকে এবং শস্য ভান্ডারে বাতাস চলাচলের জন্যও উপযুক্ত ব্যবস্থা করে রেখেছিল মহেঞ্জোদোরোর বাসিন্দারা।

এ শহরের মানুষের যে চিকিৎসা পদ্বতি নিয়ে আধুনিক ছিলো তারও প্রমাণ মেলে খননকার্যে। খনন করার সময় সেখানে পাওয়া কঙ্কালগুলোর দাঁত যখন পর্যবেক্ষণ করা হয় তখন অবাক করার মত একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়, তখনকার মানুষেরা আজকের দিনের মতো নকল দাঁত ব্যবহার করত। এটা থেকে বোঝা যায় হরপ্পা সভ্যতার মানুষেরা চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কেও অনেক এগিয়ে ছিল।

হরপ্পা সভ্যতার মানুষেরা শিল্প-সংস্কৃতিতেও আধুনিক ছিলেন বলে গবেষকরা অভিমত দিয়েছেন। শিল্পকলায় তখনকার মানুষদের বেশ আগ্রহ ছিল বলে ধারণা করা যায়। পোড়ামাটির তৈরি নানা শিল্পকর্ম পাওয়া গেছে অধিবাসীদের মধ্যে। তন্মধ্যে নৃত্য মেয়ের ব্রোঞ্চ মূর্তি অন্যতম।  অলংকার ব্যবহারের প্রচলন ছিল সেই সময়। গলার হার, কানের দুল, হাতের ব্রেসলেট জাতীয় গহনা পরার চল ছিল নারীদের মধ্যে। পুরাতত্ত্ববিদদের মতে, সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা গান বাজনা ও খেলাধুলাও চর্চা করত। গবেষকরা কিছু মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট ও খেলনার সন্ধান পেয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন চিত্রকলা, মূর্তি, বিভিন্ন রকমের পাত্র এবং অন্যান্য দরকারি জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছে যেগুলো দেশ বিদেশের বিভিন্ন সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে।

নিখুঁত নগর নির্মাণের মতোই চমকে দেয়া মহেঞ্জোদারো পতন কখন কীভাবে কেন হলো তা আজো পুরাতত্ত্ববিদদের অজানা একটি বিষয়! সেখানে প্রাপ্ত কয়েকটা জিনিস এর কার্বন ট্রেডিং করার পর কয়েকটা বিষয় তুলে ধরেছেন তারা মনে করেন জলবায়ুর বিরাট পরিবর্তন এই শহর ধ্বংস হওয়ার প্রধান কারণ ধীরে ধীরে সিন্ধু নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে এখানে জলের অভাব দেখা দেয় সেই সঙ্গে আবহাওয়া কোনো বিপদ ডেকে এনেছিল যার ফলে হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায় তবে ধ্বংসের পেছনে নিশ্চিত কোনো কারণ কী লুকিয়ে আছে সকলেরই অজানা। পুরাতত্ত্ববিদরা আজও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংসের পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণটি জানার উদ্দেশ্যে।

১৯৯৬ সালে যখন পাকিস্তান সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা সাহায্য বন্ধ করে দেয়, তখন মহেঞ্জোদারোর সংরক্ষণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরে ইউনেস্কো আবার এ ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণের জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে।বর্তমানে, ভূগর্ভস্থ লবণাক্ততা এবং ভ্রান্ত পুনর্নির্মাণ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক দেয়াল ইতোমধ্যে ভেঙ্গে গেছে এবং অন্যান্য দেয়াল ক্ষয়ে গেছে। ২০১২ সালে পাকিস্তানের প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই বলে সতর্ক করেন যে, উন্নত সংরক্ষণ ব্যবস্থা ছাড়া এলাকাটি ২০৩০ সালের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে।

লেখকঃ এস এম সজীব

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top