প্লেগঃ ইউরোপের ইতিহাসের সর্বগ্রাসী মহামারী দ্য ব্ল্যাক ডেথ

প্লেগঃ ইউরোপের ইতিহাসের সর্বগ্রাসী মহামারী দ্য ব্ল্যাক ডেথ

পৃথিবীর ইতিহাসে কিংবা একটু ছোট পরিসরে বললে ইউরোপের ইতিহাসে ব্ল্যাক ডেথের মতো আলোচিত মহামারী আর নেই। এরকম ভয়ানক, সর্বগ্রাসী রোগের প্রাদুর্ভাব সম্ভবত পৃথিবী সেই একবারই দেখেছিল ১৪ শতকে। কৃষ্ণ সাগরের (ব্ল্যাক সি) উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো থেকে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল বিধায় একে ব্ল্যাক ডেথ বলা হয়। সেসময় ইউরোপ ও এশিয়ার বাণিজ্য হতো এই কৃষ্ণ সাগর দিয়েই। বাণিজ্যিক কেন্দ্র বিন্দু হওয়ায় নানান প্রান্ত থেকে আসা মানুষই নানান প্রান্তে প্লেগ ছড়ায়ে নিয়ে যায়।

ব্ল্যাক ডেথের সময় মানুষ কোন রোগটিতে মানুষ অধিক হারে মৃত্যুবরণ করেছিল তা নিয়ে ইতিহাসবিদগণ দ্বিধাবিভক্ত। এক অংশের মতে, রোগটি ছিল একপ্রকার গ্রন্থিপ্রদাহজনিত প্লেগ। অন্য অংশের দাবি এই ভয়ানক মহামারী ঘটেছিল ইবোলা ভাইরাসের কারণে।

১৩৪৭-৫১ খ্রিস্টাব্দ সময়কালই ছিল ব্ল্যাক ডেথের সবচেয়ে বিধ্বংসী সময়। এ সময় ইউরোপের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রাণবায়ু কেড়ে নেয় এই মহামারী। তবে এই অভিশপ্ত মহামারীর প্রভাব টিকে ছিল অন্তত ২০০ বছর। ইতিহাসবিদগণের মতে, এ ২০০ বছরে অন্তত ১০ কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন! এটি এমনই এক মহামারী ছিল যে, এর কারণে সমগ্র ইউরোপের অর্থনৈতিক সার্বিক জীবন কাঠামোই বদলে যায়, প্রভাবিত হয় শিল্প সাহিত্যও। ব্ল্যাক ডেথের রেখে যাওয়া গভীর ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয় পরবর্তী বেশ কয়েক প্রজন্মের।

প্লেগঃ ইউরোপের ইতিহাসের সর্বগ্রাসী মহামারী দ্য ব্ল্যাক ডেথ

ব্ল্যাক ডেথ বিশ্বজুড়ে ডেকে আনে এক কালো মৃত্যুর অধ্যায়। সর্বপ্রথম প্লেগ হানা দেয় ইউরোপে ১৩৪৭ সালের অক্টোবরে, যখন ব্ল্যাক সমুদ্র থেকে ১২ টি জাহাজ সিসিলিয়ানের মেসিনা সমুদ্রবন্দরে পৌছায়। যখন সাধারণ মানুষেরা জাহাজের ডেকে পৌছায় তারা ভয়াবহ এক দৃশ্য দেখতে পান। তারা দেখলো যে বেশিরভাগ নাবিক সেখানে মরে পড়ে আছে এবং বাকি যে অল্প ক’জন বেঁচে ছিলেন তারা মারাত্মকভাবে অসুস্থ। তাদের শরীর থেকে রক্ত ক্ষরিত হচ্ছিলো এবং সারা গাঁ ছিলো পূঁজে আবৃত। সিসিলিয়ান কর্তৃপক্ষ অতিদ্রুত সেই মৃত্যুঝুঁকির জাহাজ গুলোকে সরিয়ে ফেলার আদেশ দিলেন। কিন্ত ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। সেই দেরি হওয়াই দাড়ালো কাল হয়ে। এরপর পরবর্তী পাঁচ বছরে ইউরোপে প্রায় ২০ লাখ মানুষ মারা গেছে। উপমহাদেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা এক্সায় বলে ধারণা করা হয়।

সেই ১২ টি মৃত্যু জাহাজ মেসিনায় পৌছানোর আগেই ইউরোপীয় মানুষেরা এই মহামারী রোগের কথা গুজবে শুনছিলো। যেটি পূর্বাঞ্চলের দূরে নিকটে বিভিন্ন জায়গায় হানা দেয়া শুরু করছিলো। প্রকৃতপক্ষে ১৩৪০ সালের শুরুর দিকে এই মহামারী অসুখ টি একে একে চীন, ভারত সহ পার্সিয়া, মিশর ও সিরিয়ায় আক্রমণ করছিলো। ইউরোপীয়ানরা সেকারণে এই “ব্ল্যাক ডেথ” এর জন্যে একপ্রকার প্রস্তুতই ছিলো। তখনই ধারণা করা যাচ্ছিলো এই মরণব্যাধি আক্রমণ চালাবে এ শহরেও। কিন্তু উপায়ন্তর ছিলো না কোনো প্রার্থনা করা ছাড়া। ইতালিয়ান কবি জিওভানি বোচাকিও প্লেগ নিয়ে বলেন, “এই ব্যাধিটি ছেলে মেয়ে উভয়েরই হতো। শুরুর দিকে এটি শরীরে স্ফীত হয়ে ফুলে থাকতো। এটি বেশিরভাগ হতো শরীরের অঙ্গের সংযোগস্থলে অথবা বগলের নীচে। সময় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুলে যাওয়া অংশগুলো ডিমের আকার ধারণ করতো। কারো কারো ছোটো অথবা বড় ধরণের হয়ে স্ফীত অংশগুলোতে পূজ আর রক্ত বের হতে থাকতো।”

সেই সঙ্গে আরো বিভিন্ন রোগের নমুনা দেখা যেতো। কারো কারো জ্বর, ডায়রিয়া লেগে থাকতো, বমি হতো, হঠাৎ করে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসতো। অত্যন্ত ভয়াবহ মৃত্যুবহর এই রোগটি চারিদিকে ছড়িয়ে যেতে থাকলো সঙ্গে প্রাণ নিতে থাকলো লাখো মানুষের। এটি এতো দ্রুত ছড়িয়ে যেতে থাকলো যে কারো প্রস্তুতি নেয়ার সময় থাকলো না। ইতালিয়ান কবি লিখেন, এটির সংক্রমণ শুরু হতো কাপড়ের স্পর্শের মাধ্যমে। এই ব্যাধিটি ছিলো সত্যিকার অর্থে ভীষণ শক্তিশালী। কখনো কখনো সুস্বাস্থ্যের কেউ কেউ ও এক রাতের এই অসুখে মৃত্যুবরণ করেছে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা ধারণা করে যে “দ্য ব্ল্যাক ডেথ” প্লেগ রোগটি এসেছিলো একটি ব্যাসিলাস ব্যাক্টেরিয়া থেকে যার নাম ‘ইয়ারসিনা পেস্টিস’। ফ্রেঞ্চ জীববিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ইয়ারসিন ১৯ শতকের শেষের দিকে এই জীবাণুর রহস্য উদঘাটন করেন। বর্তমান বিজ্ঞানীরা বলেন, এই ব্যাসিলাস জীবাণুটি সংক্রমণ হয় সাধারণত নিউমোনিয়ার মাধ্যমে অথবা বাতাসের মাধ্যমে।

কখনো কখনো এটি সংক্রমণ হতো আক্রান্ত মাছি বা ইঁদুরের মাধ্যমে। এই দুই কীটপতঙ্গ ই তখনকার মধ্যযুগীয় ইউরোপে ছিলো যেটির মাধ্যমে ইউরোপে এটি ছড়িয়ে পড়ে। তবে এই মরণ ব্যাধি রোগটি  সারা বিশ্বে একের পর এক দেশে ছড়ায় ইউরোপীয় বন্দর থেকে আগত বিভিন্ন জাহাজের মাধ্যমে। প্লেগ বেশিদিন এক নগরে আটকে থাকবার নয়, এটি দ্রুত মেসিনা ছেড়ে ফ্রান্সের মার্সেলিস বন্দরে আক্রমণ করে। একই সময় হানা দেয় নর্থ আফ্রিকার টুনিস বন্দরে। পরবর্তীতে এটি তখনকার বিশ্বে ব্যবসাবাণিজ্যের মূল কেন্দ্র রোম এবং ফ্লোরেন্সে আবির্ভাব ঘটায়। ১৩৪৮ সালের মধ্যমায় প্লেগ একে একে আঘাত হানে প্যারিস, বোরডিয়াক্স, লাইয়ন এবং লন্ডনে। তখনকার সে সময়ে কেউ বুঝতে পারতো না যে কি করে এই রোগটি একজন রোগী থেকে অন্য একজনের কাছে পৌছে যায়। অথবা কি করে করবে এই রোগের প্রতিকার? অসহনীয় এই অদ্ভুত রোগটি বছরের পর বছর এভাবে নিয়ে যায় হাজার হাজার মানুষের প্রাণ।

তথ্যসূত্র

১. রেফারেন্স

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top