যাদেরকে নিধনের মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে আধুনিক আমেরিকার সভ্যতা : রেড ইন্ডিয়ান

যাদেরকে নিধনের মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে আধুনিক আমেরিকার সভ্যতা : রেড ইন্ডিয়ান

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কোন না কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে। তবে তাদের সকলের অবস্থা ও পুর্ব ইতিহাস একরকম নয়।  কখনো  দেখা যায় কোন প্রাকৃতিক কারনে তাদের সংখ্যা ব্যাপক হারে হ্রাস পায় এবং এর দরুন তাদের সংখ্যা অনেক কমে গিয়ে নিজ দেশে উপজাতি হিসেবে পরিচিত হয়ে যায়। আবার কখনো দেখা যায় তারা অন্য শাসকগোষ্ঠী বা বহিরাগত দস্যুদের  দ্বারা নিধন হয়ে নিজ দেশে উপজাতি হয়ে যায়। বর্তমান বিশ্বের প্রায় সব আদিবাসীর গোড়ার ইতিহাস প্রায় এমন হলেও যে আদিবাসী গোষ্ঠীটি বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী আলোচনার দাবী রাখে সেটি হল আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান জাতি। কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করার পুর্বে যে আদিবাসী গোষ্ঠী সেখানে বাস করত বর্তমানে তারাই রেড ইন্ডিয়ান হিসেবে পরিচিত।

১৪৯২ সালে ইতালির নাবিক কলম্বাস কর্তৃক আমেরিকা আবিষ্কারের পুর্বে এই মহাদেশটি সম্পর্কে কারো কোন ধারনা ছিল না। যখন কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন তখন তিনি নিজেও জানতেন না যে এটি আমেরিকা কারন তিনি ভারতবর্ষে আসার জন্য সমুদ্রযাত্রা করেছিলেন। তাই স্বভাবতই তিনি আমেরিকাকে ইন্ডিয়া হিসেবে মনে করেন। তাই ঐ অঞ্চলে বসবাসরত মানুষদের ইন্ডিয়ান হিসেবে অবহিত করেন। পরবর্তীতে তাদের নামের পুর্বে রেড যুক্ত হয়ে তারা রেড ইন্ডিয়ান হিসেবে পরিচিতি পায়।   তবে  তাদের নামের পুর্বে রেড যুক্ত হবার পিছনে কয়েকটি মতামত রয়েছে। প্রথম মতটি হল তাদের গায়ের রং লালচে ছিল বলে তাদের কে রেড ইন্ডিয়ান বলা হয়। আরেকটি মত হল তাদের একটি নিজেস্ব বিশ্বাস ছিল যে গায়ে লাল রং মেখে রাখলে কোন অপশক্তি তাদের আক্রমণ করতে পারবে না তাই তারা যে কোন বিশেষ উপলক্ষ এমনকি প্রায় আচার অনুষ্ঠানের পূর্বে নিজেদের শরীরে লাল রং মেখে রাখত, তাই তাদের কে রেড ইন্ডিয়ান বলা হয়। আসলে তাদের গায়ের রং কখনো লাল ছিল না। তাই প্রথম মতটির গ্রহণযোগ্যতা অনেকটা কম এবং দ্বিতীয় মতটিকে অনেকটা সঠিক হিসেবে ধরে নেয়া হয়।

রেড ইন্ডিয়ানদের গায়ের রং অনেকটা কালচে/ বাধামী,নাক মোটা, আকৃতি লম্বা। অর্থাৎ অনেকটা মঙ্গলিয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তারা আমেরিকায় কিভাবে আসল এটি একটি বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সম্প্রতি নৃবিজ্ঞানীরা একটি মত দিয়েছেন -যে প্রায় ৩০,০০০ বছর পুর্বে আমেরিকার চিলি ও রাশিয়ার সাইবেরিয়া প্রায় কাছাকাছি অবস্থানে ছিল পরে ভৌগোলিক পরিবর্তনের ফলে প্লেট সরে গিয়ে একে উপরের থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। কিন্তু যখন এই দুই অঞ্চল একত্রে ছিল তখন এশিয়া-ইউরোপ থেকে বহু মানুষ সাইবেরিয়া হয়ে চিলির পথ ধরে আমেরিকা চলে যায়। তবে এসময় ইউরোপের তুলনায় এশিয়া হতে বেশী লোকজন গমন করেছিল। পরবর্তীতে কালের স্রোতে তারা সমগ্র পৃথিবী থেকে ক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে দীর্ঘ দিন তারা আমাদের চেনা পৃথিবীর আলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।

এসময় তাদের নিজেদের মধ্যে নিজস্ব নানা কৃস্টি/কালচার গড়ে উঠে। এখন তারা সকলে রেড ইন্ডিয়ান হিসেবে পরিচিতি পেলেও তারা নিজেদেরকে রেড ইন্ডিয়ান হিসেবে পরিচয় দেয় না। তাদের মধ্যে অসংখ্য ছোট ছোট গোত্রভিত্তিক জাতি রয়েছে। তারা এসব গোত্রীয় পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এবং রেড ইন্ডিয়ান পরিচয়কে তারা নিজেদের অপমান হিসেবে কল্পনা করে। কেননা এটা তাদের নিজেদের দেয়া কোন নাম নয়। এটি বরং তাদের ভূমিতে গমনকারী বহিরাগত অর্থাৎ ইউরোপীয়দের দেয়া নাম।

আমেরিকা আবিষ্কারের পর ইউরোপীয়রা ব্যাপক আকারে আমেরিকায় গমন করতে থাকে কারন ঐ সময়ে শিল্প বিল্পব হওয়ার দরুন কাঁচামাল সংগ্রহ, উৎপাদিত পন্য রপ্তানি এবং কলোনি তৈরির আশায় ইউরোপীয়রা দলে দলে আমেরিকায় গমন করতে থাকে। ফলে সেখানে গমন করার জন্য স্প্যানিশ, ফরাসি ও ইংরেজরা নিজেদের মধ্যে একপ্রকার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে। শুরুর দিকে আমেরিকানরা ইউরোপীয়দের সভ্যতার আশীর্বাদ হিসেবে কল্পনা করলেও পরবর্তীতে তারা বুঝতে পারে যে ইউরোপীয়রা তাদের চুষে খাওয়ার জন্যই আমেরিকায় আগমন করেছে। ফলে তারা ক্রমে নিজেদের অধিকার রক্ষায় তৎপর হতে থাকে কিন্তু তারা ঐক্যবদ্ধ ছিল না বিধায় ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে কখনো তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে নি। ফলে তারা বিচ্ছিন্নভাবে ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে শুরু করে। এসব আক্রমণে তারা সহজে ইউরোপীয়দের নিকট পরাজিত হয়। তাদের মধ্যে আবার কিছু কিছু গোত্র ইউরোপীয়দের পক্ষ অবলম্বন করে স্বজাতীয় অন্য গোত্রের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তাদের এই যুদ্ধ প্রায় ৪০০ বছর ধরে চলতে থাকে। কিন্তু তারা কোন সফলতার মুখই দেখেনি। সাথে সাথে তারা নিজ ভূমিতেই শিকার হয় হত্যা,লুন্ঠনের, হারাতে থাকে নিজেদের ভূমি, কলোনি সৃষ্টির সাথে সাথে নিজ দেশে তারা হয়ে যায় পরবাসী। সর্বশেষ ১৮৯০ সালে “উনডেড নি” নামক এক পার্বত্য খাড়ির বাঁকে তো এক যুদ্ধের মাধ্যমে তারা পরাজিত হয়ে ফের মাথা তুলে দাঁড়াবার সক্ষমতা কে চিরতরে হারিয়ে ফেলে।

আধুনিক অনেক সভ্য ঐতিহাসিক বলে থাকেন যে রেড ইন্ডিয়ান তথা আমেরিকার আদিবাসীরা ছিল অসভ্য বর্বর, শিক্ষার আলো থেকে পিছিয়ে পড়া জাতি যারা বনে জঙ্গলে বসবাস করত এবং আদিম কালের মানুষের ন্যায় জীবন যাপন করত। এই মতটি সম্পুর্ন সত্য নয়। কারন তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি জাতি ছিল যারা লিখতে পড়তে পারত ও কৃষি কাজের মাধ্যমে জীবিকা আহরন করত। বর্তমানে আমারা যে ভুট্টা,আলু দেখি তা তাদেরই আদিম ফসল। তাদের মধ্যে সিউ ও এপাচি গোত্রের লোকেরা লিখতে, পড়তে ও আগুন জ্বালাতে জানত। তবে  রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে অনেক গোত্র আবার সম্পুর্নরূপে বনে জংগলে বাস করত এবং শিকার ও সংগ্রহ ভিত্তিক জীবনে যাপন করত। তাই মোটা দাগে সকল রেড ইন্ডিয়ানদের কে সম্পুর্ন বন্য বা অসভ্য হিসেবে অবহিত করা যাবে না।

রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে ধর্মের অস্তিতেরও প্রমান পাওয়া যায়। তারা  সকলেই ইশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করত। তবে  গোত্রবেধে তাদের এই বিশ্বাসের তারতম্য ছিল। তবে  দুটি বিষয়ে সকল ধর্মের মধ্যে ঐক্যমত্য ছিল। প্রথমটি হল ব্ল্যাক মাউন্টেন কে সকলে পবিত্র স্থান হিসেবে মনে করত এবং শক্তির উৎস হিসেবে সূর্যের পুজা দিত।

বর্তমানে সমগ্র আমেরিকায় ৩.৬ মিলিয়নের মত রেড ইন্ডিয়ান রয়েছে যা মোট জনসংখ্যার ১.৬%। বর্তমানে বলিভিয়া, পেরু মেক্সিকো, ব্রাজিল, ইকুয়েডোর, গুয়েতেমালা, কলোম্বিয় প্রভৃতি দেশের কিছু অঞ্চলে রেড ইন্ডিয়ানদের সংখ্যার আদিক্যতা দেখা যায়। বর্তমানে তারা  সর্বত্র মুল ধারার নাগরিকদের সাথে খাপ খাইয়ে চলার চেষ্টা করছে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদের জন্য বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা দেয়ারও ব্যাবস্থা করা হয়েছে। ফলে তারা জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল ক্ষেত্রে মুল ধারার নাগরিকদের সাথে প্রতিযোগিতা করে সাফল্যের সাক্ষর রাখছে।

তথ্যসূত্র

১. প্রথম রেফারেন্স
২. দ্বিতীয় রেফারেন্স

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top