বাংলায় দাস ব্যাবসা, জানুন আদ্যোপান্ত

দাস ব্যাবসা – এ ইস্যুটি আমাদের ইতিহাসে খুব বেশী আলোচিত হয়নি। অথচ আমাদের এ অঞ্চলেও দাস প্রথা যেমন চালু ছল তেমনি এ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে দাস ব্যাবসাও চালু ছিল। ১৮৪০ সালে বৃটিশরা এ ব্যাপারে আইন জারী করলে এটি আস্তে আস্তে কমে আসে বা দৃশ্যমান দাস ব্যাবসা কমে আসে। কিন্তু তারপরেও ধনী সমাজে এবং ইউরোপিয়ানদের মধ্যে এ দাসপ্রথা চালু ছিল।

বৃটিশ শাসনামলের আগেও এ অঞ্চলে দাসপ্রথা বেশ জোরেশোরে চালু ছিল। ভারত তখন গ্লোবাল স্লেভ ট্রেডের সাথে বেশ ভালভাবেই যুক্ত ছিল। সে নেটওয়ার্কে আরব দেশসমূহ, পূর্ব আফ্রিকা, পার্সিয়ান গালফ, মরিশাস, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা যুক্ত ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এ দেশে পা রাখার পর তারাও দাস ব্যাবসায় জড়িয়ে পড়ে। দাস প্রথার বিরুদ্ধে  যুক্তি প্রদর্শনের সময় গভর্ণর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ড বলেছিলেন, দাসত্ব মূলত পারস্পরিক (প্রভূ এবং দাস উভয়ের) সুবিধাই  তৈরী করে। বৃটেনের বহুল্ম আলোচিত স্লেভারি এবোলিশন এক্ট ১৮৩৩ এর পর ১৮৪০ সালে কনজার্ভেটিভদের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, আনুমানিক অর্ধ মিলিয়ন দাস ভারতে বৃটিশ শাসিত অঞ্চলে রয়েছে। এরা ছিল মূলত হাবশী আর কুফরী। তবে অধিকাংশ দাসেরা ছিল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির বা যুদ্ধ বন্দি, অপহৃত শিশু কিশোর। তবে অনেক সময় অভাবের তাড়নায় বিক্রি করে দেয়া সন্তানেরাও দাস হিসেবে ব্যাবহৃত হতো।

ঐতিহাসিকদের মতে ১৭৬৯ হতে ১৭৭৩ পর্যন্ত দূর্ভিক্ষ চলাকালীন সময়ে মানুষ অভাবের তাড়নায় নিজেদেরকে বিভিন্ন জমিদারদের অধীনে দাস হিসেবে নিয়োজিত করে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ- এ কয়টি জেলা তখন দাসদের এলাকা হিসেবে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছিল। ১৮৩৯ সালে ল কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি ৫ জনের মধ্যে ১জন দাস ছিল তখন।

তখন দু ধরণের দাস ছিল। মোটা দাগে দুধরণের বলা হলেও এরা বিবিধ ধরণের কাজই করতো। একদল কৃষিকাজ করত আর অন্যদল গৃহস্থালী কাজকর্ম করত। ইন্দ্রাণী চ্যাটার্জি তাঁর ইন্ডিয়ান স্লেভারি ইন দ্য নাইনটিন্থ সেঞ্চুরী তে দাসদের ব্যাপারে বলেছেন, দক্ষ বা অদক্ষ উভয় শ্রেণির দাসই ছিল। দাসদের কোন কাজে নিয়োগ করা হবে সেটি নির্ভর করত মালিকের সম্পদ বা প্রতিপত্তির উপর। দাসদের বয়স, দক্ষতা বা সে পুরুষ না মহিলা- ইত্যাদি বিবেচনায় তাদের নিয়োগ হতো। দাসীদের গৃহস্থালী কাজে নিয়োগের পাশাপাশি রক্ষিতা হিসেবে নিয়োগের প্রবণতাও কম ছিল না। আবার সেই সাথে খোজা সম্প্রদায়ের নিয়োগের প্রাধান্য ছিল প্রহরী হিসেবে বা সৈনিক হিসেবে। দাসের সংখ্যার উপর মালিকের সামাজিক অভিজাত্যও নির্ভর করত। হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সমাজেই দাস প্রথার প্রচলন ছিল। হিন্দুগন তাদেরকে দাস বা কৃতদাস এবং মুসলমানরা তাদেরকে গোলাম বা নফর বলেই অভিহিত করত। অনেকক্ষেত্রে দাসের সন্তানেরাও একই মালিক বা তাঁর বংশধরের দাস হিসেবে নিয়োজিত থাকত।

১৭৮০ সালে এবোলিশনিস্ট আন্দোলনের সময় বৃটিশ শাসকেরা ভারতবর্ষে দাস প্রথা উচ্ছেদের কার্যক্রম শুরু করলেও এটি কার্যকর হতে অনেক লম্বা সময় নেয়। ১৮৪৩ এর এক্ট ফাইভে আবার দাসপ্রথাকে পুরো রহিত করাও হয়নি। এতে প্রথমে দাস হিসেবে মানুষ আমদানী বা রপ্তানী বন্ধ করা হয়। সামাজিক বিবিধ সংস্কার , শিল্প বিপ্লব এবং সেই সাথে মুক্ত শ্রমের প্রচলনে ধীরে ধীরে দাস ব্যাবসা গুটিয়ে আসে।

এতক্ষণ বৃটিশ শাসনামলের দাস ব্যাবসা নিয়ে আলোচনা করলেও এ অঞ্চলে দাস ব্যাবসা চালু হয় আরো আগে। পর্তুগীজরা এ অঞ্চলে আসার পরপরই দাস ব্যাবসা কে তারা একটি পূর্ণাংগ ব্যাবসাতে পরিণত করে। বাণিজ্যের পাশাপাশি পর্তুগিজদের এদেশে আসবার আরেকটি প্রধান লক্ষ্য ছিল খ্রীষ্টধর্মের প্রসার। ১৪৯৮ সালে কালিকটে পৌঁছানোর পর এক বণিকের প্রশ্নের জবাবে ভাস্কো-দা-গামার জাহাজের এক নাবিক উত্তর দিয়েছিলেন, “আমরা খ্রীষ্টান ও মশলার সন্ধানে এসেছি”। তবে ধর্মপ্রচারের পাশাপাশি পর্তুগিজদের আরেকটি অন্ধকার দিক ছিল দাস ব্যবসা। ১৬২১ থেকে ১৬২৪ সালের মধ্যে পর্তুগিজরা সুন্দরবন তথা বাংলার নদী সংলগ্ন অসংখ্য গ্রাম থেকে হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে মোট প্রায় ৪২,০০০ মানুষকে ক্রীতদাস বানিয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে যায়, যাদের মধ্যে প্রায় ২৮,০০০ মানুষকে ধর্মান্তরিত করা হয়। ১৬৬৬ সালের এক নথি থেকে জানা যায় তখন শুধুমাত্র হুগলীতে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ছিল আট থেকে নয় হাজার।

শ্রাবণী বসু লিখছেন-‘ভারতবর্ষে ইউরোপীয়রা দাস ব্যবসা বা দাস প্রথা চালু করেনি। বহু প্রাচীন কাল থেকে এই প্রথা চালু ছিল। তবে ভারতবর্ষের দাসত্বের যে সংজ্ঞা প্রাচীন বা মধ্য যুগে পাওয়া যায় ইউরোপীয়রা তার পরিবর্তন ঘটায় । প্রাচীন কালে জাতিভেদ প্রথার মধ্যে দাসত্বের পরিচয় পাওয়া যায় । দাসদাসী হাতবদল বা দান করার প্রথাও চালু ছিল বলে জানা যায় । মধ্যযুগে মুসলমানী শাসকদের আমলেও দাস বিক্রির বাজার ছিল ।…কিন্তু দেখা যাচ্ছে ধনতন্ত্র বিকাশের যুগে দাসরা একটা বস্তুতে পরিণত হচ্ছে । ১৭২৩ সালের ২০ জানুয়ারী লেখা এক ফরাসীর বিবাহের চুক্তিপত্রে দেখা যায় অস্থাবর বস্তু সামগ্রীর সঙ্গে ১৮ জন দাস দাসীর কথা উল্লেখ আছে। ১৭১২ সালে ১লা এপ্রিল লেখা এক চুক্তিপত্রের থেকে জানা যায় এক দম্পতি ২৬২ টাকার বিনিময়ে তাদের বাড়ি, সম্পত্তি, গয়নাগাঁটির সঙ্গে দাসদেরও বন্ধক রাখে’।

আগেই বলেছি যে, পর্তুগিজরা নিঃসন্দেহে অন্যমাত্রা দিয়েছিল দাসপ্রথাকে। পর্তুগিজদের সাথে হাত মিলিয়ে মগ দস্যুরাও একই কাজ করেছে এ অঞ্চলে। বন্দরে বন্দরে মানুষবিক্রির খেলায় মেতে উঠেছিল ফিরিঙ্গিরা। তাদের এই দাস ব্যবসার কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম, বরিশাল, নোয়াখালি এলাকা। দীনেশ্চন্দ্র সেন তাঁর ‘বৃহৎবঙ্গ’ গ্রন্থে বলেন –

“মগদস্যুরা পর্তুগীজদিগের সঙ্গে যোগ দিয়া দেশে যে অরাজকতা সৃষ্টি করিয়াছিল তাহা অতি ভয়াবহ। তাহাদের স্পর্শদোষে অনেক ব্রাহ্মণ পরিবার এখনও পতিত হইয়া আছেন। বিক্রমপুরের মগ-ব্রাহ্মণদের সংখ্যা নিতান্ত অল্প নহে। মগ ও পর্তুগীজদের ঔরসজাত অনেক সন্তানে এখনও বঙ্গদেশ পরিপূর্ণ। ফিরিঙ্গিদের সংখ্যা চট্টগ্রাম, খুলনা ও ২৪ পরগনার উপকূলে, নোয়াখালীতে, হাতিয়া ও সন্দ্বীপে, বরিশালে, গুণসাখালি, চাপলি, নিশানবাড়ী, মউধোবি, খাপড়াভাঙ্গা, মগপাড়া প্রভৃতি স্থানে অগণিত। ঢাকায় ফিরিঙ্গিবাজারে, তাহা ছাড়া কক্সবাজারে ও সুন্দরবনের হরিণঘাটার মোহনায় অনেক দুঃস্থ ফিরিঙ্গি বাস করিতেছে।”

আর এতে সায় ছিল বাংলার জমিদারদেরও। তাঁরাই দাস-দাসী নিয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছিলেন দিন। তবে দাস প্রথা যে শুধু মাত্র চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল হার্মাদরা এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। অর্থনৈতিক কারণে বাংলার মানুষও নিজেদের বিক্রি করত দাস হিসেবে।

বাংলার কোণায় কোণায় গজিয়ে উঠেছিল দাসের হাট । ‘তাঁতী বউ’-এ অমিয়ভূষণ মজুমদার সেরকমই একটি হাটের উল্লেখ করেছেন, দিয়ে গিয়েছেন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ-‘জমিদারেরা নিজে আসতেন, এমনকী উজিররাও কেউ কেউ আসতেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে । এদিকে বাঁদী-বান্দার দোকান। টাকা দিয়ে বান্দা পাওয়া যেত জোয়ান, বুদ্ধিমান, কৌশলী, পাঠান, মোবলা, খোজা, হিন্দু যার যেরকম চাই। বাঁদীও পাওয়া যেতো মুলতানি, গুজরাটি, আফগানি,শাদা, গোলাপি, শ্যামলা, কখনো বসরা থেকেও আসত। এসব দোকানের বর্ণনা ইতিহাস যা দিয়েছে তার চাইতে ভাল বলা যায় না। আনারকলি, নূরজাহাঁ এসব দোকানের বেসাতি।.’

কলকাতায় বেচাকেনার জন্য থাকত দালাল বা মধ্যভোগীরা । ইন্ডিয়ান রিফরমার পত্রিকার পাতায় লেখা হয়েছে-‘In Calcutta and other places, there are brokers for buying bondmen and bondwomen. After convicting some low-caste females of adultery, they employ them as servants, and on pretence of travelling, they sell them.’

জেমস টেলর তাঁর কোম্পানী আমলে ঢাকা গ্রন্থে তাঁর সমকালীন সময়ে ঢাকায় দাসপ্রথার ব্যাপারে লিখেছেন। সে সময় একজন পুরুষ দাসে মূল্য ১৪০ টাকা এবং মেয়ে দাসীর মূল্য ১০০ টাকা ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি এদের ব্যাপারে আরো লিখেন যে, অনেক সময় অনেককে ঘৃণ্যভাবে শহরের পতিতালয়ে বিক্রয় করে দেয়া হয়।  তবে দেশের এ অঞ্চলে অধিকাংশ দাসদাসীরা সরকার কর্তৃক তাদের রক্ষার অধিকার প্রদানের ব্যাবস্থা সম্পর্কে সচেতন এবং মাঝে মাঝে ব্যাক্তিবিশেষ ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে এটা দাবি করে থাকে। তাদের অনেকে এভাবে মুক্তি লাভ করেছে এবং দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে।

আজ হয়ত সমাজ বদলে গেছে। সেসময়কার মতো দাসত্ব ব্যাপারটা এখন হয়ত নাই। তবে ভিন্ন আংগিকে এখন আধুনিক দাসত্ব রয়েই গেছে। দাসত্বের সংজ্ঞা পালটে গেলেও পৃথিবীর একটি বিরাট অংশ এখনো দাস হিসেবেই জীবনকাল সাংগ করে।

সূত্রঃ
১। হিস্টরি অব দ্য পর্তুগিজ ইন বেংগল, জোয়াকিম জোসেফ এ. ক্যাম্পোস, অনুবাদকঃ শানজিদ অর্ণব, দিব্য প্রকাশ
২। কোম্পানি আমলে ঢাকা, জেমস টেলর, অনুবাদকঃ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, অবসর প্রকাশনা
৩। Slavery in Bengal: A forgotten history. Rasim Alam, Daily star, 07 October 2018
৪। DailyHunt.in

লেখকঃ বোরহান মাহমুদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top