পৃথিবীতে পাওয়া প্রথম লিখিত ভাষা : সুমেরীয় ভাষা

মানব সভ্যতার শুরু থেকে কথ্য ভাষা কেমন ছিলো কেউই নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না। কথ্য ভাষার পরিবর্তন বিবর্তন মানুষের মুখে মুখে প্রতিনিয়ত হচ্ছে। কিন্তু সেই মুখের ভাষায় শুরুর ইতিহাস জানা না থাকলেও ভাষা যখন থেকে লেখায় রূপ নেয় তার ইতিহাস কিছুটা জানার সুযোগ আমাদের থাকে। ভাষার উৎপত্তি ঠিক কবে ও কীভাবে হয়েছিল সেটা নিয়ে মতভেদ আছে। প্রাচীন ভাষার লিখিত রূপ নানান পাথর কিংবা শিলালিপি এমনকি দেয়াল খোদায় করে লেখা অনেক ভাষার আবিষ্কার হলে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো লিখিত ভাষা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়। সংস্কৃত, গ্রিক, হিব্রু এগুলো অনেকদিনের পুরনো ভাষা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসলেও ভাষাতত্ত্বের জ্ঞান বাড়ার সাথে সাথে মানুষ জানতে পেরেছে পৃথিবীতে আরও কয়েক হাজার বছরের পুরনো ভাষার কথা।

ভাষা সভ্যতার চাইতেও প্রাচীন, স্বভাবতই এর জন্মকথা নিশ্চিত করে বলা যায় না।  তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, লিখন পদ্ধতি আবিষ্কারের আগে যেসব ভাষা ছিল তাদের সম্পর্কে প্রায় কিছুই আর আমাদের জানার উপায় নেই। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ প্রাচীন মিশরীয় লিপি পাঠোদ্ধারের পর লিখিত ভাষার প্রাচীনত্ব নিয়ে অনেক চমকপ্রদ তথ্য উদ্ধার হতে থাকে। তবে এখন থেকে প্রায় ৪,৮০০ বছরের পুরোনো হলেও মিশরের হায়ারোগ্লিফকে পৃথিবীর প্রথম লিখন ব্যবস্থা হিসেবে ধরা হয় না। সাধারণত লিখিতভাবে পাওয়া সবচেয়ে পুরনো ভাষা হিসেবে ধরা হয় মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় ভাষাকে। প্রথম পাওয়া লিপির বয়স ৫,১০০ থেকে ৪,৯০০ বছরের মতো। দাপ্তরিক এবং রাজকীয় দলিলপত্র ছাড়াও সুমেরীয় ভাষাতে প্রচুর ধর্মীয় এবং সাহিত্যিক রচনা পাওয়া গিয়েছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া পৃথিবীর প্রথম মহাকাব্যিক কাহিনী ‘গিলগামেশ’ এই ভাষাতেই রচিত।

সুমেরীয় সভ্যতা ও তাদের ভাষা

বর্তমান ইরাকের টাইগ্রীস ও ইউফ্রেটিস (তৎকালীন দজলা ও ফোরাত) নদীর মধ্যবর্তী উর্বর স্থানে সুমেরীয় সভ্যতার গোড়াপত্তন ঘটে। পশ্চিম এশিয়ার জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে নবপোলয়ী পর্যায় থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে প্রথম যে সভ্যতা গড়ে উঠে তাই সুমেরীয় সভ্যতা। এ জন্যই সুমেরীয় সভ্যতা কে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার স্রষ্টা বলা হয়। ধর্ম, আইন, লিখনপদ্ধতি, সাহিত্য ও বিজ্ঞান ও শিল্পকলার বিভিন্ন শাখায় এ সভ্যতা বেশ কিছু অবদান রাখে, যা পরবর্তী অনেক সভ্যতা এ সুমেরীয় সভ্যতাকে অনুকরণ করে। সুমেরীয়দের ভাষাই পৃথিবীতে এখনো পর্যন্ত পাওয়া প্রাচীন লিখিত ভাষা।।

পৃথিবীর প্রাচীন এ ভাষা আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগেই ব্যাবহার বন্ধ হয়ে গেছে। মৌখিকভাবে এর ব্যাবহার বন্ধ হয়েগেলেও আরো প্রায় দু’হাজার বছর এর লিখিত রূপ চলতে থাকে, পরবর্তীতে  আক্কাদিয়ান ভাষা সুমেরীয় ভাষার স্থান দখল করে নেয়।  ব্যাপারটি অনেকটা ল্যাটিন ভাষার সাথে তুলনীয়। ল্যাটিন মরে যাওয়ার পরও মধ্যযুগ জুড়ে ধর্মীয়, গবেষণাগ্রন্থ, গুরুত্বপূর্ণ দলিল ইত্যাদি লেখার কাজে ল্যাটিন ব্যবহৃত হতো। সুমেরীয়দের কাছ থেকে সভ্যতা হস্তান্তর হয়ে আক্কাদিয়ানদের কাছে আসার পর তারা পুরোপুরিই তাদের পূর্বসূরিদের ঐতিহ্য বজায় রেখেছিল।

সুমেরীয় ভাষা পুনরুদ্ধার

সুমেরীয়দের কাছ থেকে আক্কাদিয়ান, তারপর উত্তরে আশিরিয়া ও দক্ষিণে ব্যাবিলনে ভাগ হয়ে যায় এই সভ্যতা। কিন্তু ৫৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইরানী সাম্রাজ্য গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার দখল নেওয়ার পরও পবিত্র ভাষা হিসেবে সুমেরীয়র চর্চা ছিল। ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দিগ্বিজয়ী আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট এই অঞ্চলের দখল নেওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে সুমেরীয়, আক্কাদিয়ান ও কিউনিফর্মের চর্চা হারিয়ে যেতে থাকে এবং একটা সময়ে প্রাচীন সুমের মানুষের স্মৃতি থেকে লোপ পায়।

মধ্যযুগ জুড়ে ভ্রমণকারীরা ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যে বিচিত্র এই লিখনপদ্ধতি দেখে দেখে এর মর্মোদ্ধারের চেষ্টা করে এসেছে, কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি। ঊনবিংশ শতক জুড়ে ধাপে ধাপে ইউরোপে এই লিপির পাঠোদ্ধার চলতে থাকে। প্রথমে কিউনিফর্মে লেখা সনাতন ফার্সির পাঠোদ্ধার করা হয়, এরপর তার চেয়ে প্রাচীন আক্কাদিয়ানের। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ধারণা করা হয়, এই লিপির ইতিহাস আরও প্রাচীন। ১৮৫৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামরিক অফিসার স্যার হেনরি রলিনসন ঘোষণা করেন, দক্ষিণ ইরাকে আলাদা একটি ভাষার লিপি পাওয়া গিয়েছে। জার্মান পণ্ডিত পাউল হাউপ্ট সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক উপায়ে সুমেরীয় ভাষার বিশ্লেষণ করেন। সুপ্রাচীন এই লিপির বিভিন্ন চিহ্নের হরেক রকম উচ্চারণ ও অর্থ প্রথমদিকে অসুবিধার সৃষ্টি করে, কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক খননে যত বেশী মাটির ফলক উদ্ধার হতে থাকে, ধীরে ধীরে এই ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান তত বাড়তে থাকে।

সুমেরীয় ভাষার বৈশিষ্ট্য

পৃথিবীর বেশীরভাগ ভাষা একটার সাথে আরেকটা সম্পর্কিত। এর মানে বিভিন্ন ‘ভাষা-পরিবার’ আছে। যেমন ইন্দো ইউরোপিয়ান, দ্রাবিড়িয়ান, সেমিটিক ইত্যাদি ভাষা পরিবার। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, স্প্যানিশ, রুশ ইত্যাদি ইন্দো ইউরোপিয়ান পরিবারের সদস্য। সেই কারণে এদের ভিতর কমবেশী মিল দেখা যায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সুমেরীয় ভাষার সাথে আর কোনো ভাষারই মিল পাওয়া যায় না। এটি কোনো ভাষা-পরিবারেরই সদস্য নয়। এজন্য সুমেরীয়কে বলা হয় ‘ল্যাংগুয়েজ আইসোলেট’ বা বিচ্ছিন্ন ভাষা।

লিখিত আকারে পাওয়া প্রথম ভাষা হওয়ার কারণে প্রচুর গবেষণা হয়েছে সুমেরীয়কে নিয়ে, অনেক ভাষার সাথে একে মেলানোর চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এমনিতে এটি একটি ‘আগলুটিনেটিভ’ (Agglutinative) ভাষা। যেসব ভাষা বিভিন্ন শব্দ একটার সাথে আরেকটা জুড়ে আরেকটি শব্দ তৈরি করা হয়, তাদের বলা হয় আগলুটিনেটিভ। যেমন সুমেরীয়রা তাদের ভাষাকে বলত ‘এমে.ঙির’। ‘এমে’ অর্থ স্থানীয় আর ‘ঙির’ অর্থ ভাষা। দুটি আলাদা শব্দ একসাথে জোড়া লেগে একটি আলাদা শব্দ হয়েছে।

একদম শুরুর দিকে (৩৩০০ থেকে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ভিতর) সুমেরীয় লিখন পদ্ধতি ছিল শব্দনির্ভর, অর্থাৎ সাধারণত একটি চিহ্ন দিয়ে একটি সম্পূর্ণ শব্দ প্রকাশ করা হতো। কয়েক শতাব্দী পর এই ব্যবস্থা সহজ করার জন্য ‘লোগোসিল্যাবিক’ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। এতে করে একটি চিহ্ন দিয়ে একটি আস্ত শব্দ না বুঝিয়ে একটি শব্দাংশ বা সিল্যাবল প্রকাশ করা হতো। এখনও চৈনিক এবং জাপানি ভাষা লেখার জন্য মোটামুটি একইরকম পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। কাঠের তৈরি ত্রিভুজাকার মাথার কলম নরম মাটির ফলকে গেঁথে এই চিহ্নগুলি আঁকা হতো, এজন্য এই লিখনপদ্ধতিকে বলা হয় ‘কিউনিফর্ম’ যার অর্থ ‘গোঁজ-আকৃতি’।

যেহেতু সুমেরীয় টুকরো টুকরো অংশ জোড়া লাগিয়ে গড়া যায়, এই বিচিত্র শব্দাংশনির্ভর লিখনপদ্ধতি দিয়েই ভাষাটা লিখতে সুবিধা হতো। সুমেরীয়দের পর আক্কাদিয়ানরা যখন এই সভ্যতার উত্তরাধিকার লাভ করে, তারাও তাদের ভাষা লেখার জন্য এই লিখনপদ্ধতিই গ্রহণ করে, যদিও আক্কাদিয়ান ভাষার সাথে সুমেরীয়র কোনো মিলই নেই। ক্লাসিক্যাল যুগের আগে প্রাচীন যুগে কিউনিফর্ম খুবই জনপ্রিয় লিখনপদ্ধতি ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের বিলুপ্ত ভাষা উগারিটিক এবং সনাতন ফার্সি ভাষা লেখার জন্য কিউনিফর্মের উপর ভিত্তি করে তৈরি লিখনপদ্ধতি গ্রহণ করা হয়।

লেখকঃ এস এম সজীব

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top