হারিয়ে যাওয়া মৌর্য সাম্রাজ্যের নগর : পাটলিপুত্র

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ভারতের বিহারের পাটনা শহরের অদূরে গড়ে উঠেছিল এক সমৃদ্ধ শহর। মৌর্য সম্রাট অশোকের রাজধানী পাটলিপুত্র, যে শহরের মূল প্রাসাদ দেখে চীনা পর্যটক ফাহিয়েন বলেছিলেন কোন মানুষের পক্ষে এমন প্রাসাদ তৈরি করা সম্ভব নয়। জৌলুস আর বিত্ত বৈভবে এমনই অতুলনীয় ছিল হারিয়ে যাওয়া মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজধানী পাটলিপুত্র। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ অব্দে মগধের রাজা অজাতশত্রু সর্বপ্রথম ছোট আকারে এ শহর প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ শতকের প্রথমার্ধে খননকার্যের ফলে বেরিয়ে আসে এ নগর নিয়ে সব চমকপ্রদ তথ্য।

যেমন ছিল পাটলিপুত্র

খ্রিস্টের জন্মের প্রায় তিন চারশো বছর আগে ভারতবর্ষে এসেছিলেন গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস। তার পুরো সফরের আদ্যোপান্ত নিয়ে পরবর্তীতে তিনি রচনা করেন তার সাড়া জাগানো বই ইন্ডিকা। এই বইয়ের মাধ্যমেই পৃথিবীবাসী সর্বপ্রথম পাটলিপুত্র নামের এক সমৃদ্ধ শহরের সন্ধান পায়। শুধু তাই নয় ইন্ডিকায় দেওয়া বর্ণনাই পরবর্তীতে হয়ে উঠে ভারতের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এই বইয়ে মেগাস্থিনিস পাটলিপুত্রকে বলেছেন তার নিজ ভাষায় ‘পালিমব্রোথস’। তৎকালীন পর্যটকদের এক ধরণের মুদ্রাদোষ ছিল যে, যা দেখবেন তার চেয়ে বেশি বলবেন। কিন্তু ইন্ডিকায় পাটলিপুত্রের বর্ণনা যেভাবে পাওয়া যায় তা অনেকাংশেই সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে পরবর্তী প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে। গঙ্গা আর শোন নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত পাটলিপুত্র নগর পুরোটা ছিল বড় বড় দালানে বেষ্টিত। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকা হতে পাটলিপুত্র পর্যন্ত চওড়া রাজপথ ছিল। বহু দূর দূরান্ত থেকে মানুষ ভাগ্যান্বেষনের আশায় এ শহরে এসে ভিড় করত। কাঠের তৈরি উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল পুরো পাটলিপুত্র শহর৷ প্রাচীরের মাঝে মাঝে ছিল মস্ত বড় ফটক।  এমন ৬৪ টি ফটকের বর্ণনা দিয়েছিল মেগাস্থিনিস৷ শহরে ছিল প্রায় ৫০০ টির মত কেল্লা। কেল্লাতে সর্বদা সৈন্য প্রস্তুত রাখা হত৷ শহরের নিরাপত্তার জন্য বড় একটা পরিখা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল। ভারতের বিহার এলাকার প্রাচীন মগধ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে এই রাজ্য গড়ে উঠলেও পরবর্তীতে পূর্ব প্রান্তে বাংলাদেশ থেকে শুরু করে পশ্চিমে পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল।  ১৯১২ থেকে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাটি খুঁড়ে এখান থেকে ৮০ টি কাঠের স্তম্ভযুক্ত বড় হলঘরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে৷ ধারণা করা হয় এখানে মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সভাকেন্দ্র ছিল। বিহারের কাছাকাছি প্রায় ১৭ টি জায়গায় প্রত্নতাত্ত্বিক খোড়াখুড়ি করে প্রাচীন এ শহরের বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষের প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রাচীনকালে গঙ্গা নদী পাটলিপুত্রের পাশ দিয়ে বয়ে গেলেও এখন সে স্থান থেকে নদীটি প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূরে সরে গেছে। বুলান্দিবাগ নামক এলাকায় পাওয়া গেছে পাটলিপুত্রকে ঘিরে রাখা সেই কাঠের প্রাচীরের অস্তিত্ব। বুলান্দিবাগের দক্ষিণ -পূর্ব দিকের কুমারঘর নামক এলাকায় একটা বড় হলঘরের সন্ধান পাওয়া গেছে।  সেখানে ১০ টি সারিতে মোট ৮০ টি খুঁটি পোঁতা ছিল। এই ৮০ টির মধ্যে ১০ টির চিহ্ন খুব স্পষ্টভাবেই পাওয়া গেছে। হলঘরের কাছ দিয়ে বয়ে যেত খাল। সেই খালে নৌকায় করে লোকরা এসে ৭ টি কাঠের চওড়া পাটাতন পেরিয়ে হলঘরে যেত। এই বিশাল হলঘরটি গুপ্ত রাজাদের আমলে আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। ৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে চীন থেকে ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন পরিব্রাজক ফাহিয়েন। পাটলিপুত্রের সম্রাট অশোকের রাজপ্রাসাদ দেখে তিনি এতটাই বিমোহিত হয়েছিলেন যে নিজ দেশে গিয়ে এ নিয়ে তিনি বলেন, এমন প্রাসাদ কোন মানুষের পক্ষে বানানো সম্ভব না।

কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোকের শহর ছেয়ে গিয়েছিল নীতিস্তম্ভে। পাটলিপুত্র তখন হয়ে উঠেছিল এক মানবিক নগর। সেই অভিজাত শহর সময়ের বিবর্তনে মাটি চাপা পড়ে আছে। নেই প্রিয়দর্শী সম্রাট অশোকও৷ পাটলিপুত্রের ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়ালে এক অপার হারিয়ে যাওয়ার বেদনা বুদবুদ করে যেন। আহা পাটলিপুত্র!

তথ্যসূত্রঃ বিশ্বের সেরা পুরাকীর্তি – খন্দকার মাহমুদুল হাসান

লেখকঃ উবায়দুর রহমান রাজু

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top