গ্রিস : পাশ্চাত্য সভ্যতার জন্মভূমি

গ্রিসকে পাশ্চাত্য সভ্যতার জন্মভূমি বলে মনে করা হয়। গ্রিস দেশটির জন্ম আনুমানিক তিন হাজার বছর আগে। খ্রিস্টপূর্ব দু হাজার অব্দ থেকে মিনেয়ান প্রভুরা ভূমধ্যসাগরের এই অঞ্চলের বিভিন্ন দ্বীপে গড়ে তুলেছিলেন নিজেদের বিশাল সাম্রাজ্য। ক্রেটান, মাইসেনিয়ান, জেরিয়ান প্রভৃতি সংস্কৃতির হাতে ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে গ্রিক সভ্যতা। অবস্থানগত এবং অন্যান্য নানারকম সুবিধা থাকার কারণে এথেন্সই হয়ে ওঠে গ্রীস দেশের অন্যতম শহর। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে গণতন্ত্রের জন্ম এই এথেন্স নগরিতেই। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই রাজ্য পরিচালনা করতেন। নির্বাচনে যাঁরা অংশ নিতেন না, শাস্তি স্বরূপ তাদের মুখে লাল রং মাখিয়ে দেওয়া হতো। এথেন্সে খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৫ থেকে ৪৩১ পর্যন্ত দুর্দান্ত দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেন পেরিক্লিস।

পেরিক্লিসের সময়েই এথেন্সের সৌন্দর্য সবচাইতে বেশি বিকশিত হয়। এসময় নির্মিত হয় ইতিহাস প্রসিদ্ধ পার্থেনন মন্দির। সেই যুগে পর পর অনেক জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক ও চিন্তাবিদ জন্মেছিলেন গ্রিসে। সাহিত্যে আবির্ভাব হয় ইসকাইলাস, সফোক্লিস এবং ইউরিপিডিসের মতো যুগস্রষ্টাদের। ভাস্কর্যে ফিডিয়স, ইতিহাসে থুকিডিডেস, হেরোডেটাস, দর্শনে পারমেনিডেস, জুনো এবং জগদ্বিখ্যাত সক্রেটিস আবির্ভূত হন সে যুগেই। সক্রেটিসের যোগ্য শিষ্য প্লেটো তাঁরই দর্শনের ভিতের ওপর গড়ে তোলেন আদর্শ রিপাবলিকের থিসিস। রাজনীতি ও দর্শনে পাশ্চাত্য সভ্যতার উপর গভীর ছাপ রেখে গেছেন তিনি। প্লেটোর লেখা বই ‘রিপাবলিক’ এখনও সারা পৃথিবী জুড়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে পঠিত হয়।

ইউনেস্কো গ্রীসের পার্থেননকে ‘ওয়ার্লড হেরিটেজ সাইট’ হিসাবে ঘোষণা করেছে। এথেন্স শহরের মাঝখানে অ্যাক্রোপোলিস পাহাড়ের উপর অবস্থিত এই পার্থেনন আসলে একটি প্রাচীন মন্দির। ‘ডরিক’ শৈলীতে তৈরি ৩১ মিটার চওড়া, ৭০ মিটার লম্বা এবং ২০ মিটার উঁচু এই বিশাল মন্দির পুরোটাই মার্বেলের। ৪৬টি বিশাল (প্রতিটি ২ মিটার মোটা) স্তম্ভের উপরে ছিল ছাদ, যা বর্তমানে নেই। মন্দিরের মাঝখানে ছিল হাতির দাঁত, মূল্যবান কাঠ এবং স্বর্ণ নির্মিত ১২ মিটার উঁচু এথেনা দেবীর মূর্তি। সে মূর্তিও এখন নেই। এথেনার নামেই এই শহরের নাম এথেন্স। এথেনা ছিলেন বিদ্যা, বুদ্ধি এবং আধ্যাত্মিকতার দেবী, তবে প্রয়োজনে যুদ্ধও করতেন সমান দক্ষতায়।

ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে গ্রিস বিভিন্ন বিদেশি রাজ্যের অধীনে ছিল। তাই পার্থেনন কখনও গির্জা, কখনও মসজিদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। গ্রিস যখন তুরস্কের অধীনে ছিল, তখন তুর্কি সেনারা পার্থেননকে দুর্গ হিসাবে ব্যবহার করে। ১৬৮৭ সালে যুদ্ধের সময় তাদের বারুদের গুদামে আগুন লেগে বিস্ফোরণ হয়। ফলে পার্থেননের অনেকটা অংশ ধ্বংস হয়ে যায়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের শাসকগণ পার্থেননের অনেক ভাস্কর্য ও মূর্তি ইংরেজ রাজদূত লর্ড এলগিনকে বিক্রি করে দেয়। লর্ড এলগিন এগুলি জাহাজে করে ইংল্যান্ডে নিয়ে যান। ব্রিটিশ সরকার তাঁর কাছ থেকে সেই সব ভাস্কর্য কিনে পরে তা ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রেখে দেয়। তখন থেকে এগুলি ব্রিটিশ মিউজিয়ামেই আছে এবং ‘এলগিন মার্বেলস’ নামে বিখ্যাত। গ্রিক সরকার অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও সেগুলি আজও ফেরত পায়নি। সেগুলো কেমন দেখতে ছিল তা বোঝানোর জন্য কিছু কিছু মূর্তির নকল বানিয়ে বসানো হয়েছে— যেমন পার্থেননের প্রবেশদ্বার ‘প্রপিলিয়া’র একাংশে নারী মূর্তির আকারের স্তম্ভগুলি।

পার্থেনন মন্দিরটির পাহাড় থেকে নামবার সময় চোখে পড়বে দু’টি প্রাচীন থিয়েটার। ডাইওনিসাস ও হেরোডিয়ন। ২৪০০ বছরের পুরনো ডাইওনিসাস থিয়েটারের বিশাল ধ্বংসাবশেষ দেখে অবাক হতে হয়। এখানে ১৬ হাজার দর্শকের আসন আছে। ইতিহাস বলে, প্রাচীন গ্রিসে নাটকের খুব প্রচলন ছিল। সে সময়ের বেশির ভাগ গ্রিক নাটকই ছিল বিয়োগাত্মক। ইউরিপিডিস, সফোক্লিস, আরিস্টোফেনিস প্রভূতরা ছিলেন গ্রিসের বিখ্যাত নাট্যকার। ১৮০০ বছরের পুরনো ‘আউটডোর থিয়েটার’ হেরোডিয়নে ১২০০ দর্শকাসন আছে। একে মেরামত করে প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অ্যাক্রোপোলিস পাহাড়ের পাদদেশে নবনির্মিত অ্যাক্রোপোলিস মিউজিয়াম একটি বড় আকর্ষণ। আধুনিক শৈলীতে কাচ ও স্টিলে নির্মিত এই মিউজিয়ামের বিভিন্ন তলায় গ্রিক সভ্যতার বিভিন্ন সময়ের মূর্তি, ভাস্কর্য, দেওয়ালে খোদাই করা শিল্প ইত্যাদি সাজানো হয়েছে খুবই রুচিসম্মত ভাবে। গ্রিক সভ্যতার অনেক জিনিস পৃথিবীর অন্যান্য মিউজিয়ামেও রাখা আছে। সেগুলোর মধ্যে ব্রিটিশ মিউজিয়াম বা ল্যুভর মিউজিয়াম অন্যতম। তাদের অনেক প্লাস্টার প্রতিলিপিও রাখা হয়েছে এখানে। ভাল করে দেখতে গেলে বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে।

পার্থেননের মন্দির এবং সংশ্লিষ্ট বাড়িগুলো নির্মিত হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৭ থেকে ৩২ -এর মধ্যে। নকশা গড়েছিলেন ইকতিপোস এবং কালিকার্তেস্ নামের সেকালের দুজন মহান স্থপতি। কুড়ি হাজার দক্ষ প্রকৌশলীর মেধা এবং চার লক্ষ ক্রীতদাসের শ্রমের বিনিময়ে নির্মিত হয়েছিল এথেন্সের এই স্বপ্নসৌধটি। সে যুগের মানুষের শিল্প পিপাসা কতখানি ছিল সে বিষয়ে তর্ক অনাবশ্যক। তবে একটি বিষয় সে যুগের মানুষ নিশ্চিত হতে পেরেছিল যে, কারিগরি দক্ষতা এবং সৌন্দর্যচেতনা সমান পরিমাণে না থাকলে কালজয়ী শিল্প সৃষ্টি সম্ভব নয়। শুধু আবেগ দিয়ে এরকম শিল্প নির্মাণ করা যায় না, চাই মেধা এবং শারীরিক নৈপুণ্য। তাইতো পরবর্তীকালে পার্থেননকে সেই যুগলমিলনের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ববাসী।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top