নূর এনায়েত খানঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় গোয়েন্দা নারী

নূর এনায়েত খান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় গোয়েন্দা নারী

২০১২ সালের নভেম্বরে লন্ডনের গর্ডন স্কয়ার গার্ডেনে উন্মোচন করা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোয়েন্দা রানী খ্যাত ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারী নূর এনায়েত খানের ভাস্কর্য। যুক্তরাজ্যে কোন মুসলিম ও এশীয় নারীর প্রতিই এটিই বৃটেনের প্রথম সম্মান। ইতিহাসের পাতায় প্রবলভাবে উপেক্ষিত এই নারী কে ছিলেন? কি তার বৃত্তান্ত? কেনই বা তার ভাস্কর্য স্থাপন করল যুক্তরাজ্য? এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা পাব এক হার না মানা নারীর জীবনের গল্প। কোমল এক নারীর বিপজ্জনক স্পাই হয়ে উঠার গল্পে শুধুই নূর এনায়েত খান ওরফে নোরা বাকেরের সাহসিকতা আর হাল না ছাড়ার বর্ণনা।

১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি মস্কোতে ভারতীয় বাবা এবং আমেরিকান মায়ের ঘরে জন্ম নেন নূর এনায়েত খান। তার বাবার নাম এনায়েত খান মা পিরানি আমেনা বেগম। বাবা ছিলেন একজন সংগীতজ্ঞ এবং সূফি শিক্ষক। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এনায়েত খান পরিবার নিয়ে মস্কো থেকে লন্ডনে চলে আসেন।  যুদ্ধ শেষ হলে ১৯২০ সালে এনায়েত খান পরিবার নিয়ে এবার থিতু হন প্যারিসে। এই প্যারিসেই নূর এনায়েত খান শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠেন। নিরব,  শান্তশিষ্ট, লাজুল স্বভাবের নূর এনায়েত প্যারিসের স্বভাবসুলভ সংগীতের সাথে পরিচিত হয়ে বাশি, পিয়ানো বাজানো শিখতে থাকেন। বাবার সূফিবাদের সাথে পরিচিত হয়ে এক উদার ধর্মীয় স্বভাবে তিনি বেড়ে উঠেন। তাছাড়া প্যারিসে তিনি কবিতা ও ছোটদের জন্য গল্পও লিখতে থাকেন। অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশে স্বস্তিতেই কাটছিল নূর এনায়েতের জীবন। কিন্তু আবার বাঁধ সাজে সর্বনাশা যুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মানির নাজি সৈন্যরা ফ্রান্স দখল করে নিলে নূর এনায়েত খান পরিবারের সাথে নৌকাযোগে আবার ইংল্যান্ডে আসেন। তার আগে ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ফ্রেঞ্চ রেডক্রসে একজন সেবিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইংল্যান্ডে এসেই চিরচেনা শান্তস্বভাবের নূর এনায়েত বদলে যান। এক নতুন এনায়েতকে দেখার জন্য ইতিহাস যেন মঞ্চ তৈরি করে রেখেছিল।

নূর এনায়েতের বদলে যাওয়া

নূর এনায়েত কখনো কোন দেশকে পরাধীন দেখতে চাননি। তিনি এবং তার ভাই ভিলায়াত চেয়েছিলেন নাজিদের বিরুদ্ধে তারা (ভারতীয়রা) যদি এমন কোন সাহসী ভূমিকা রাখতে পারেন ইংরেজদের পক্ষ হয়ে তবে সেটা পরবর্তীতে ইংলিশ এবং ভারতীয়দের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে পারবে। আর সেজন্য নভেম্বর ১৯৪০ সালে নূর এনায়েত Women’s auxiliary air force (Waaf) এ প্রথম নারী ওয়ারলেস অপারেটর হিসেবে নিযুক্ত হোন।

টিপু সুলতানের রক্ত বইয়ে বেড়ানো নূর এনায়েত খুব শীঘ্রই  ব্রিটেনের Special operation executive (soe) এর নজর কাড়তে সক্ষম হোন। সেখানে গুপ্তচর হিসেবে অভিষেক হয় নূর এনায়েতের। একজন গল্প লেখিকার জীবন হঠাৎ করে তুখোড় গুপ্তচরবৃত্তিতে রূপ নেয়। এখানে এসে নতুন নাম নোরা বাকেরে পরিণত হোন নূর এনায়েত। ১৯৪২ সালে তিনি ব্রিটেনের এলিট স্পাই স্কোয়াডে অন্তর্ভুক্ত হোন। গুপ্তচর হিসেবে তার কোডনেম ছিল মেডেলিন। এই মেডেলিনই জার্মান দখলকৃত প্যারিসে গিয়ে ১৯৪৩ সালে নাজি বাহিনীর নাকের ডগায় গিয়ে ব্রিটেনের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করতে থাকেন। নূর এনায়েতের জীবন নিয়ে গবেষণা করা মিস বসু বলেছেন, একজন শিশু গল্পকার, সংগীতজ্ঞ পরিবর্তিত হয়ে বাঘিনীতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। ফ্রান্সে হিটলারের পুলিশ বাহিনী গেস্টাপো এবং সব ইন্টেলিজেন্সের চোখে ধূলা দিয়ে নূর এনায়েত খান ধারাবাহিকভাবে ইংল্যান্ডে নাজিদের গোপন তথ্য সমৃদ্ধ রেডিও মেসেজ পাঠাতে থাকেন। জার্মানরা তাদের শত্রু কোলে করে বেড়াচ্ছে কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না, এমন ঝানু স্পাই হয়ে উঠেছিলেন এই ভারতীয় নারী। কিন্তু খুব বেশিদিন মেডেলিন তার পরিচয় গোপন রাখতে পারেননি। তার দলের অন্য সদস্যরা গেস্টাপোর হাতে ধরা পড়ে। ইংল্যান্ড থেকে জরুরি বার্তা আসে নূর এনায়েত খানকে আসতে হবে নয়তো সমূহ সম্ভাবনা আছে জার্মানদের হাতে ধরা পড়ার। কিন্তু নূর এনায়েত নিজে প্যারিস জুড়ে একা একটি স্পাই গ্রুপ  চালিয়ে যান আরো তিনমাস। কিন্তু অবশেষে তার পরিচয় ফাঁস হয়। ধরা পড়েন মেডেলিন নামের নোরা বাকের। তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রায় ১০ মাস শারীরিক নির্যাতন, না খাইয়ে রাখা হয়৷ কিন্তু কোনভাবেই নাজিরা তার কাছ থেকে কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। এরই মধ্যে নূর এনায়েত দুইবার পালানোর চেষ্টা করেন এবং ধরা খান। এতে করে তাকে নাজিরা বিপজ্জনক আসামী বলে উল্লেখ করে। সেপ্টেম্বর ১৯৪৪ সালে নূর এনায়েত খান এবং আরো তিন SEO এজেন্টকে ডাচা কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে ট্রান্সফার করা হয় এবং ১৩ এ সেপ্টেম্বর গুলি করে হত্যা করা হয়।  গেস্টাপোর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেছিলেন নোরা বাকের৷ কিন্তু ভুলক্রমে তার কাছে একটি নোটপেড পেয়ে যায় জার্মানরা। এই নোটপেড থেকে তথ্য নিয়ে ব্রিটেনের অনেক গোপন মিশন ব্যর্থ করে দেয় নাজিরা।

তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ফ্রান্সে তার স্মরণে দুইটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। তার মৃত্যুদিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয় সেখানে। পেয়েছেন ফ্রান্সের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এই নারী খুব কমই আলোচনার টেবিলে জায়গা করে নিতে পেরেছেন।

তথ্যসূত্র

  1. https://www.bbc.co.uk/history/historic_figures/inayat_khan_noor.shtml
  2. https://en.m.wikipedia.org/wiki/Noor_Inayat_Khan
  3. https://www.bbc.com/news/uk-20240693

লেখকঃ উবায়দুর রহমান রাজু

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top