সরস্বতি রাজমনিঃ নারী হয়েও নেতাজির আর্মির সর্বকনিষ্ঠ স্পাই

সরস্বতি রাজমনি

নারী হয়েও নেতাজির আর্মির সর্বকনিষ্ঠ স্পাই

কোনো কালে জয়ী হয়নিকো একা পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয়ী লক্ষ্মী নারী। না শুধু প্রেরণা আর শক্তিই নয় পুরুষের সাথে সমান তালে চলতেও শিখিয়েছে কিছু নারী। কখনো বন্ধুক হাতে, কখনোবা পুরুষের ছদ্মবেশে নাজেহাল করেছে শত্রু পক্ষকে। যাদের সাহস, শক্তি বুদ্ধির কাছে সব কিছুই যেনো মলিন হয়ে যায়।

আজকে আলোচনা করবো এমনই একজন নারীকে নিয়ে  যার নাম ইতিপূর্বে হয়তো অনেকেই শুনেনি। যার নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা নেই। কিন্তু তিনি ইতিহাসের অংশ হয়েই রয়েছেন। তিনি হলেন সরস্বতি রাজমনি। নেতাজি শুভাষ চন্দ্র বসুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত স্পাই। সেই সময় কালে ব্রিটিশদের এক ভয়াবহ আতঙ্কের নাম ছিলো রাজমনি।  সরস্বতি রাজমনি।
 
১৯২৭ সালে ভিয়েতনামের বা তৎকালীন বার্মার এক বিপ্লবী পরিবারে  তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। ছোট থেকেই তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা। দেশের প্রতি প্রবল প্রেম ছিলো তার। শুধু মাত্র দেশপ্রেমই নয় অত্যন্ত বুদ্ধিমতি ও শক্তিশালী ছিলেন রাজামনি। মাত্র ১০ বছর বয়সেই তিনি দেখা করেন মহাত্মা গান্ধীর সাথে। শোনা যায় মহাত্মা গান্ধী যখন তার বাড়িতে প্রবেশ করছিলেন তখন দেখতে পান রাজামনি বন্দুক চালানোর অনুশীলন করছিলেন। এমনই দুর্দান্ত ছিলেন তিনি।

বড় হওয়ার সাথে সাথে তার কানে আসে নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজের কথা। নিয়মিত তিনি নেতাজির বিভিন্ন বক্তৃতা শোনা শুরু করেন। এই বক্তৃতা শুনতে শুনতেই তার দেশপ্রেম আরো বেশি জাগ্রত হয়ে উঠে। তিনি মনে মনে ঠিক করে ফেলেন যে আজাদ হিন্দ ফৌজ বাহিনীতে তিনি যোগদান করবেন। যেই ভাবনা সেই কাজ।

তাঁর যখন ১৬ বছর বয়স, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে রেঙ্গুনে গিয়েছিলেন নেতাজী৷ উদ্দেশ্য ছিল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির জন্য অনুদান সংগ্রহ করা৷ তখন নিজের সমস্ত সোনা ও হীরের গয়না নেতাজীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন সরস্বতী রাজমণি৷ কিন্তু তা গ্রহণ করেননি নেতাজী৷ পরের দিন সরস্বতীর বাড়িতে গিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সব গয়না৷  নেতাজি তখন ভেবেই নিয়েছিলেন যে, নিশ্চয়ই এটা তার অল্প বয়সের ছেলেমানুষি। কিন্তু নেতাজি বুঝতে পারেননি এই মেয়ে পিছু হাঁটার মেয়ে নয়। অবশেষে নেতাজি তাকে আজাদ হিন্দ ফৌজ বাহিনীর সদস্য করে নেন। তখন থেকেই রাজমনি আজাদ হিন্দ বাহিনীর হয়ে কাজ করতে থাকেন। তিনি ছেলের ছদ্মবেশ ধরে  ব্রিটিশ শাসকদের বাড়িতে বিভিন্ন সময় কাজ করতে যেতেন। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের হয়ে কাজ করতে শুরু করেন রাজমনি।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কাছে তিনি বিভিন্ন শাসকদের প্রতিটি বৈঠকের খবর খুব গোপনীয়ভাবে পৌঁছে দিতেন। এইভাবে তিনি  নিজের প্রানের ঝুঁকি নিয়ে গোপনে আজাদ হিন্দ ফৌজ এর জন্য  কাজ করেছেন। ছদ্মবেশে ছেলে সেজে  ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ অফিসারের বাড়িতে কাজ করতে যেতেন সরস্বতী৷ তারপর সেখানে হওয়া নানান বৈঠক ও ভারত বিরোধী বিভিন্ন তথ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির হাতে তুলে দিতেন তিনি৷ এইভাবে ছেলে সেজে প্রায় দু’বছর তিনি বিভিন্ন ব্রিটিশ সরকারি ভবনেও কাজ করেছিলেন৷

যদিও পরবর্তী সময় দুর্ভাগ্যবশত তিনি ধরা পড়ে যান এবং ব্রিটিশ সরকারের গুলি খেয়ে তিনি এবং তার ৪ বন্ধু ৩ দিন গাছের উপর লুকিয়ে ছিলেন।

একবার তাঁর এক সহকর্মী ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়লে তিনি একজন নর্তকীর বেশ ধরে সোজা হানা দেন ব্রিটিশ ক্যাম্পে। এরপর তিনি ব্রিটিশ অফিসারকে মদ খাইয়ে তাঁর সেই সহকর্মীকে নিয়ে সেখান থেকে পালান, কিন্তু পালানোর সময় তাঁর একটি পা ব্রিটিশদের গুলিতে মারাত্মকভাবে জখম হয়।

১৯৪২ সালে রানী ঝাঁসি বাহিনীতে যোগ দেন সরস্বতী রাজমনি।  ছেলেদের ছদ্মবেশ ধরে তিনি ও আরো অনেক বাহিনীর জন্য বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জোগাড় করতে থাকেন কয়েক বছর ধরে। নেতাজির অনেক ভরসার পাত্রী ছিলেন তিনি।   নেতাজির শেষ নিশ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত তিনি বাহিনীর গুরুত্ত্বপূর্ণ পদে ছিলেন তিনি।

জীবনের শেষ সময়টা ভালো কাটেনি রাজমনির। অর্থিক টানাপোড়ন,  অভাব তাকে গ্রাস করে নিয়েছিলো।  দিন অনেক গড়িয়েছে, স্বাধীনতা পেয়েছে ভারত৷ তবে পাল্টায়নি সরস্বতী রাজামণির জীবন৷ ২০০৫ খবরে প্রকাশিত হয় যে তাঁর আর্থিক অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জোগাড় করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছিলো তার।
   
এমন অবস্থায়  তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী কুমারী জয়ললিতা তাঁকে এককালীন ৫ লক্ষ টাকা ও আজীবন থাকার জন্য একটি বিনা ভাড়ার ঘরের ব্যবস্থা করেন। ২০১৯ সালের ১৩ জানুয়ারী তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে  অন্তিম পথে যাত্রা করেন।
 
সেই ছোট্টবেলা থেকেই দেশ, মা, মাটির জন্যে লড়াই করে গেছেন তিনি। কিন্তু তার দেশ বা দেশের মানুষের কাছে সেরকম কোনো প্রতিদান পান নি তিনি। অবশ্য বিজয়ীরা, বিপ্লবীরা প্রতিদানের পরোয়া করেনা।  তারা শুধু আত্মত্যাগ করেই যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top