ড্যাসমন্ড ডস
যিনি নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে উদ্ধার করেছেন শতাধিক যুদ্ধাহত প্রাণ
“Lord, Please help me get one more. Please help me get one more” বলে হ্যাকস রিজের যুদ্ধের ময়দানে চিৎকার করছেন ড্যাসমন্ড ডস। শতাধিক আহত আমেরিকান সৈন্যকে হ্যাকস রিজের মাঠে রেখে পিছু হটে আমেরিকান সৈন্য। কিন্তু একজন সৈন্য ফিরে চলে আসেনি, ২য় প্লাটুনের মেডিক ড্যাসমন্ড ডস। আহত সৈন্য একজনকেও যুদ্ধের ময়দানে রেখে তিনি ফিরে যাবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। আজ জানবো তাঁর বীরত্বগাথা।
ড্যাসমন্ড ডস, আমেরিকান এক মধ্যবিত্ত খৃষ্টান ধর্মীয় পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা মাতা ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করতেন সবসময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিলো তখন, ডস পারিবারিক চাপে আমেরিকান মিলিটারিতে যোগ দেয়। মিলিটারি ট্রেনিং খুব ভালোভাবেই পার করছিলেন ডস। সাধারণ প্রশিক্ষণের পর যখন অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে হবে তখন বাঁধে বিপত্তি। ডস অস্ত্র হাতে নেবেন না। ছোটবেলাইয় একবার তার এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে ঝগড়ায় মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন তিনি, এরপর তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কাউকে তিনি কখনো আঘাত করবেন না। আরেকবার তার পিতা যখন মদ খেয়ে মাতাল হয়ে তার মা কে মারতে উদ্যত হয়েছিলেন, তখন ডস পিস্তল হাতে পিতাকে খুন করার জন্য এগিয়ে যায়, পরে বুঝতে পেরেছিলেন এ ভীষণ অন্যায়। তখন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি আর কখনো অস্ত্র হাতে নেবেন না। মিলিটারি অফিস থেকে নানানভাবে তাকে চাপ দেয়া হয়, কিন্তু তিনি নাচোড়বান্দা। অস্ত্র প্রশিক্ষণ তিনি নেবেন না, তিনি কখনো অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করবেন না। এর জন্য তাকে অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয়। সহ্য করতে হয় নানান নির্যাতন। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মেডিকেল টিম মেম্বার হিসেবে যুদ্ধে যোগদান করেন।
১ এপ্রিল ১৯৪৫ এ মার্কিন বাহিনী ওকিনোয়া দ্বীপ দখলের জন্য জাপানের ওকিনোয়া দ্বীপে গমণ করেন। ওকিনোয়া দ্বীপ দখলের জন্য একটা টিম হ্যাকস রিজের দিকে যায়। তাদের সাথে ছিলেন ডস। পরদিন হ্যাকস রিজে মুখোমুখি মার্কিন সৈন্য বাহিনী ও জাপানি সৈন্য বাহিনী৷ হ্যাকস রিজ ছিলো ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে পাহাড়ি সমতল ভূমি। সেখানে এক গুহায় জাপানি সৈন্য বাহিনীর ঘাটি। ভূপৃষ্ঠ থেকে হ্যাকস রিজে উঠার জন্য দড়ির সিঁডি লাগানো হয়। মার্কিন সৈন্য বাহিনী হ্যাকস রিজে পৌঁছালে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। দিনের অর্ধভাগে মার্কিন বাহিনী সামনের দিকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে যায়, ট্যাংক সহ জাপানি অনেক ঘাটি ধ্বংস করে ফেলে। দিনের শেষভাগে শুরু হয় জাপান সোইন্য বাহিনীর পালটা আক্রমণ৷ বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসে, মার্কিন বাহিনী সামলাতে না পেরে দ্রুত পিঁছু হটে, ইতোমধ্যেই শতাধিক নিহত, আরো শতাধিক আহত। হ্যাকস রিজ থেকে দ্রুত নেমে আসে মার্কিন সেনারা। ততক্ষনে মার্কিন নৌ বাহিনী হ্যাকস রিজে গোলা বর্ষন করে আবার বিধ্বস্ত করে জাপানি সেনাদের৷ এদিকে মার্কিন বাহিনী তাদের ঘাটিতে ফিরে এলেও শতাধিক আহত সৈনিক হ্যাকস রিজে পড়ে রয়। ক্যাপ্টেন দ্রুত অন্যান্য প্লাটুন থেকে সহায়তা চান হ্যাকস রিজ থেকে আহত সৈনিকদের ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু তখন সৈন্য স্বল্পতা থাকায় সেদিন সন্ধ্যায় উদ্ধারের জন্য হ্যাকস রিজে কাউকে পাঠানো সম্ভব হয়নি।
ক্যাপ্টেন তখনো জানতেন না তাদের একজন সৈন্য ফিরে আসে নি। ড্যাসমন্ড ডস। ডস দেখতে পাচ্ছেন একের পর এক আহত মার্কিন সেনা। তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আহত সৈনিকদের উদ্ধার না করে ফিরবেন না। ডস একা ছুটাছুটি করতে শুরু করেছেন, যেখানেই আহত সেনা দেখতে পাচ্ছেন সেখানেই তিনি তার ব্যাগে থাকা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে নিয়ে আসছেন হ্যাকস রিজের ঢালের কাছে। বিপত্তি বাঁধে তখন, এত উঁচু ঢাল থেকে তিনি একা কি করে নামাবেন? আর যদি তিনি একা একজন সেনাকে নিয়ে নেমে যান তাহলে বিপত্তি বেঁধে যাবে বাকিদের নিয়ে, তারা কি করে নামবে! তারপর আশেপাশে থাকা রশি জোগাড় করে তাতে বেঁধে তিনি এক এক করে আহত সেনাদের নিছে নামাচ্ছেন।
এমন চলতে চলতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গভীর রাত্রি, তার হাত দিয়ে আহত সেনা কর্মকর্তা এক এক নিরাপদে হাসপাতালের পথে যাওয়ার জন্য নামছে। বারবার রশিতে বেঁধে সৈনিকদের নামাতে হাত রশির দাগে কেটে যাচ্ছে, শরীরের ক্লান্তি আর শায় দিচ্ছে না, তবু তার মন প্রার্থনা করে যাচ্ছে “Lord, Please help me get one more. Please help me get one more”। এভাবে সারারাত্রি খুঁজে ৭০-১০০ আহত মার্কিন সেনা উদ্ধার করে নিছে পাঠিয়েছেন। সকাল সকাল জাপান সৈন্য বাহিনী যখন বের হয় তখন ডস বিপদের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। পরে অনেক খুঁজেও আহত আর কাউকে না পেয়ে তিনি আহত ক্লান্ত শরীর নিয়ে নেমে আসেন। ততক্ষণে হ্যাকস রিজে আসা সকল সেনা জানতে পারে হ্যাকস রিজে ডস একাই লড়াই করছেন আহত সৈনিকদের ফিরিয়ে আনার জন্য।
প্রশিক্ষণ চলাকালীন অস্ত্র হাতে না নেয়ার জন্য তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা সেই সহজ সরল ছেলেটা আজকে সকলের জন্য দেবদূত হয়ে দাড়িয়েছে। নিজেকে যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুর ঝুঁকিতে রেখে একে একে আহত সেনাদের ফিরিয়ে এনেছেন, যেখানে আর কেউ উদ্ধারের কথা ভাবতেই পারেনি। পরদিন আরেক প্লাটুন মার্কিন সেনা হ্যাকস রিজে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। শ্রান্ত ক্লান্ত ডসকে রেখে হ্যাকস রিজের যুদ্ধে কেউ যাচ্ছে না। ২১ মে ১৯৪৫, সেদিনের যুদ্ধে ডস মারাত্মকভাবে আহত হয়। স্নাইপার বুলেটের আঘাতে তার বাঁহাত মারাত্মকভাবে ফ্র্যাকচার হয়। এছাড়াও তার শরীরের ১৭ স্থানে বোমার আঘাতের ক্ষত পাওয়া যায়। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়।
হ্যাকস রিজের সেই বীরত্বগাথার জন্য আমেরিকার সর্বোচ্চ সামরিক পুরষ্কার ‘ম্যাডেল অব অনার’ এ ভূষিত হন ড্যাসমন্ড ডস। এবং তিনিই একমাত্র ব্যাক্তি যিনি যুদ্ধের ময়দানে কোনরকম অস্ত্রের ব্যাবহার না করে এই পুরষ্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি তার জীবদ্দশায় গুয়াম ও পিলিপাইনের যুদ্ধে অবদানের জন্য দু’বার ব্রোঞ্জ স্টার ম্যাডেল’ অর্জন করেন। মার্চ ২৩, ২০০৬ সালে বার্ধক্যজনিত ও শ্বাসকষ্টের কারণে এ মহান ব্যাক্তি মৃত্যুবরণ করেন। তার জীবনীর উপর অনেক বই, সিনেমা, ডকুমেন্টারি নির্মিত হয়েছে।