নর্তকী হতে গুপ্তচর- রহস্যময়ী নারী মাতাহারি

নর্তকী হতে গুপ্তচর- রহস্যময়ী নারী মাতাহারি

মার্গারিটা গ্রিট্রুডিয়া জিলি। হল্যান্ডে জন্ম। নাম শুনে চট করে চেনার কোন উপায় নেই। কিন্তু যদি বলা হয় এই নামের আড়ালে আছে পৃথিবীখ্যাত নারী গুপ্তচর মাতাহারি তাহলে সবার ইতিহাস চেতনা সায় দেবে। নৃত্য পারদর্শিতা, রূপ, যৌবন, স্বীয় বুদ্ধিমত্তা এবং নিজের জীবনের স্বত্ত্বাকে খুঁজে বেড়ানো এই নারীর বিশ্বব্যাপী পরিচয় – তিনি ছিলেন গুপ্তচর।

মাতাহারি জন্মেছিলেন ১৮৭৬ সালে নেদারল্যান্ডে। চার ভাই-বোনের সবার বড় ছিলেন। তাঁকে ডাকা হতো মার্গারিটা বলে। তাঁর পিতা এডামের একটি টুপির দোকান ছিল। পরবর্তীতে তিনি তেল শিল্পে বিশাল অংকের টাকা বিনিয়োগ করে যথেষ্ট সম্পদশালী হন। প্রচুর অর্থবিত্ত থাকায় মার্গারিটা তার শৈশবে বেশ বিলাসী জীবনযাপন করেন। ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি খুব ব্যয়বহুল স্কুলে লেখাপড়া করেন। এর কিছুদিন পরেই ১৮৮৯ সালে মার্গারিটার পিতা দেউলিয়া হয়ে যান, তার পিতামাতার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় এবং ১৮৯১ সালে তার মাতা মারা যান। ৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৩ সালে তার বাবা সুসান্না ক্যাথারিনাকে বিয়ে করেন। তবে তাদের কোন সন্তান ছিল না। এরপর মার্গারিটা তার পিতামহের সাথে বসবাস করতে শুরু করেন। একই সাথে একজন শিশু শিক্ষিকা হবার জন্য পড়াশুনা শুরু করেন। উক্ত স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ায় তার পিতামহ তাকে সেখান থেকে প্রত্যাহার করে নেন। কিছুদিন পর সেখান থেকে পালিয়ে তিনি হেগ শহরে তার চাচার বাড়িতে চলে যান।

মার্গারিটা বিয়ে করে বসলেন

মার্গারিটার যখন ১৮ বছর বয়স, তখন ডাচ সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে একজন সামরিক কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন রুডলফ ম্যাকলেওডকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ উপনিবেশে (বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া) বসবাস শুরু করেন। ১১ জুলাই ১৮৯৫ সালে আমাস্টারডামে তাদের বিয়ে হয়। ক্যাপ্টেন রুডলফকে বিয়ে করার সুবাদে তিনি তৎকালীন ডাচ সমাজের অভিজাত শ্রেণিতে প্রবেশ করার সুযোগ পান। বিয়ের পর তারা পূর্ব জাভা দ্বীপের মালাঙে চলে যান। সেখানে তাদের দুই সন্তান, নরম্যান-জন ম্যাকলিওড (৩০ জানুয়ারি ১৮৯৭) এবং লুই জেনে ম্যাকলিওড (২ মে ১৮৯৮) জন্ম নেয়।

তাদের বিয়ে সুখের ছিল না। ম্যাকলিওড মদ্যপ ছিলেন। তিনি মার্গারিটার চেয়ে ২০ বছরের বড় ছিলেন। ক্যাপ্টেন ম্যাকলিওড প্রায়ই তার স্ত্রীকে প্রহার করতেন। তার ধারণা ছিল মারগারিটার কারনেই সামরিক বাহিনীতে তার পদোন্নতি হচ্ছে না। তার একজন প্রকাশ্য রক্ষিতাও ছিল। তৎকালীন ডাচ ইস্ট ইন্ডিজে একজন রক্ষিতার সাথে সম্পর্ক রাখা ছিল একটি সাধারণ ব্যাপার। ফলে তাকে সাময়িকভাবে ত্যাগ করে ভ্যান রিড নামে অপর একজন সামরিক অফিসারের কাছে চলে যান। মার্গারিটা কয়েকমাস ধরে নিবিড়ভাবে ইন্দোনেশিয়ান রীতিনীতি শেখেন এবং একটি নাচের কোম্পানিতে যোগদান করেন। ১৮৯৭ সালে তিনি “মাতা হারি” (মালয় ভাষায় যার অর্থ সূর্য বা দিনের চক্ষু) নাম নেন। ১৯০২ সালে রুডলফের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় মাতাহারির। তত দিনে তাঁরা নেদারল্যান্ডসে ফিরে এসেছেন।

প্যারিস যাত্রা

১৯০৩ সালে সালে প্যারিস যান মাতাহারি। সেখানকার একটি সার্কাস দলে লেডি ম্যাকলিয়ড নাম নিয়ে নাম লেখান। যদিও ম্যাকলিয়ড পরিবার এতে তুমুল আপত্তি জানিয়েছিল। জীবিকার জন্য তিনি চিত্রশিল্পীদের মডেল হিসেবেও কাজ করতেন। ১৯০৫ সালে মাতাহারির নাম ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর নাচ খুব দর্শক টানত। তাঁর উত্তেজক অনেক আলোকচিত্রও পাওয়া যাচ্ছিল বাজারে। উঁচু মহলে তাঁর যোগাযোগও তৈরি হচ্ছিল। পত্রপত্রিকায় তাঁকে নিয়ে লেখাও ছাপা হচ্ছিল। যৌনতা ও শরীর প্রদর্শনের মাধ্যমে মাতা হারি খুব দ্রুত দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তিনি নিজেকে জাভার এক রাজকুমারী হিসাবে জাহির করতেন। নাচের মঞ্চে তার সাহসী খোলামেলা উপস্থাপনা ছিল দর্শক আকর্ষণ করার হাতিয়ার। মাতা হারির নৃত্য উপস্থাপনার সবচেয়ে দর্শকপ্রিয় অংশটি ছিল নৃত্যরত অবস্থায় ক্রমে শরীরের সমস্ত বস্ত্র বিসর্জন দেয়া। নাচের শেষে শুধুমাত্র একটি বক্ষবন্ধনি এবং হাতে ও মাথায় কিছু অলংকার অবশিষ্ট থাকত। বক্ষবন্ধনি ছাড়া তাকে খুব কমই দেখা যেত কারণ তিনি তার সংক্ষিপ্ত স্তনযুগল নিয়ে খুব সচেতন ছিলেন। তবে ১৯১৫ সাল নাগাদ তাঁর নাচের ক্যারিয়ারে ধস নামে। তবে তত দিনে অনেক রাজনীতিবিদ, সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর সখ্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে…

নেদারল্যান্ডস নিরপেক্ষ ছিল। বিশ্বযুদ্ধে দেশটি কোনো পক্ষেই জড়ায়নি। মাতাহারি ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসের মধ্যে মাঝে মধ্যেই যাতায়াত করতেন স্পেন আর ব্রিটেন হয়ে। সেসময় ক্যাপ্টেন ভাদিম মাসলভের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান মাতাহারি। মাসলভ ছিলেন ফ্রান্সে নিয়োজিত রুশ পাইলট। ১৯১৬ সালের বসন্তে মাসলভ ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে যুদ্ধরত ছিলেন। ওই গ্রীষ্মেই মাসলভ মারাত্মকভাবে আহত হন। দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। মাতাহারি প্রেমিককে হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার অনুমতি চান। হাসপাতালটি যুদ্ধক্ষেত্রের কাছেই ছিল। নিরপেক্ষ দেশের মানুষ হওয়ায় অনুমতি মিলছিল না। জার্মানদের গোপন খবর এনে দেওয়ার শর্তে ফ্রান্সের এক গোয়েন্দা সংস্থা তাঁকে অনুমতি দিতে রাজি হয়। মাতাহারি যুদ্ধের আগে ক্রাউন প্রিন্স ভিলহেল্ম মানে জার্মানির কাইজার ভিলহেল্ম টু-র ছেলেকে অনেকবার নাচ দেখিয়েছেন। প্রিন্স তখন ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টের সিনিয়র জার্মান জেনারেল। গোয়েন্দা সংস্থাটি এ খবর জানত এবং বিশ্বাস করত মাতাহারি প্রিন্সকে আবার প্রলুব্ধ করতে পারবে। ১৯১৬ সালের নভেম্বরে জাহাজে চড়ে রওনা হলেন মাতাহারি। কিন্তু ব্রিটিশ বন্দর ফলমাউথে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো। নিউ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড তাঁর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনল। মাতাহারি ফ্রান্সের হয়ে কাজ করার কথা স্বীকারও করলেন। তাঁর কথার সত্যতা প্রমাণিত হলে তিনি ছাড়াও পেলেন। ওই বছরের শেষাশেষি তিনি মাদ্রিদে চলে গেলেন। সেখানে একজন জার্মান সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর দেখা হলো। কর্মকর্তাকে মাতাহারি অনুরোধ করলেন প্রিন্সের সঙ্গে মোলাকাত করিয়ে দিতে। আরো জানালেন, টাকা পেলে ফ্রান্সের কিছু গোপন খবর তিনি জার্মান বাহিনীকে দিতে পারেন।

ডাবল এজেন্টের নাম এইচ টুয়েন্টি ওয়ান

১৯১৭ সালের জানুয়ারি মাসে একজন জার্মান গুপ্তচরের কথা জানতে পারে ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থাটি। গুপ্তচরের নাম এইচ টুয়েন্টি ওয়ান। টুয়েন্টি ওয়ানের ওপর নজরদারি বৃদ্ধি করা হলো। ফরাসিদের মনে মাতাহারির নামই আসছিল টুয়েন্টি ওয়ানের ক্ষেত্রে। আর ওদিকে জার্মান জেনারেল ওয়াল্টার নিকোলাই বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন মাতাহারির ওপর। তিনি প্যারিসে শোনা কিছু গুজবই সরবরাহ করছিলেন মাত্র। নিকোলাই তাঁকে বরখাস্ত করলেন।

১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯১৭, মাতা হারিকে এলিস প্যালেস নামে একটি হোটেল কক্ষ থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল গোপন সংবাদ পাচারের মাধ্যমে ৫০,০০০ ফরাসি সৈন্যকে হত্যার ঘটনায় জার্মানিকে সহায়তা করা। ধারনা করা হয় তার হোটেল কক্ষে অদৃশ্য কালি পাওয়া গিয়েছিল যা পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনে সাহায্য করে। মাতা হারি দাবি করেছিলেন যে এই কালি ছিল তার মেক আপের সামগ্রী। ২৪ জুলাই গুপ্তচর বৃ্ত্তির দায়ে তার বিচার শুরু হয়। তবে নিশ্চিত প্রমাণ হাজির করা যায়নি। ওই সময় ফরাসি সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহও ছড়িয়ে পড়ে। তাই বিচার কার্য কিছু সময় থমকে যায়। তবে জেরার এক পর্যায়ে মাতাহারি স্বীকার করেন, তিনি জার্মানদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন।

তারপর ১৯ অক্টোবর ১৯১৭ সাল। সেদিন প্যারিসের এক প্রাচীন দূর্গ ‘কাসেরানি দ্য ভেনসিনেস’-এ সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করে এই নারী গুপ্তচরকে। বৃটিশ সাংবাদিক হেনরি ওয়ালেস এই খবরটি আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাগুলোতে প্রচার করেন। খবরটি ছিল এরকম, ‘‘সৈন্যরা এসে সারবন্দী হয়ে দাঁড়ালো দূর্গের ভেতরে। তাদের হাতের বন্দুক তখনও নামানো। একজন নন কমিশন অফিসার দন্ডায়মান এই দলটির পেছনে। একটু পরেই মাতাহারিকে নিয়ে একটি গাড়ি প্রবেশ করলো দূর্গে। মাতাহারি শান্ত ভঙ্গীতে গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে দাঁড়ালেন একটি কাঠের তক্তার সামনে। কাঠের দন্ডটির সঙ্গে তাকে বেঁধে ফেলার পর নিয়ম অনুযায়ী এলেন পুরোহিত। তার কথা শেষ হওয়ার পর এক সামরিক অফিসার মাতাহারির মাথায় পড়িয়ে দিতে চাইলো সাদা মুখোশ। মাতাহারি প্রশ্ন করলেন,‘এটা কি আমাকে পড়তেই হবে’? অফিসার উত্তরে বললেন ‘সেটা আপনার ইচ্ছা। তাতে কিছু আসবে যাবে না’।

অকম্পিত ভঙ্গীতে মাতাহারি দাঁড়িয়ে রইলেন সেখানে। নন কমিশন অফিসারের হাতে ধরা তরবারিটি শূণ্যে উঠে গেলো। তারপর নেমে এলো অমোঘ নির্দেশের মতো। গুলি ছুঁড়লো সৈন্যরা। গুলির আঘাতে মাতাহারির শরীর খানিকটা ঝুঁকে, পা ভাঁজ করে ঝুলে রইলো কাঠের তক্তার সঙ্গে। নিষ্পলক দৃষ্টি আকাশের দিকে, সে দৃষ্টিতে ছিলো না কোন অভিযোগ’’।

মাতাহারিকে নিয়ে প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র তৈরী হয় জার্মানীতে ১৯২০ সালে। এই নারী গুপ্তচরের জীবন নিয়ে এরপর ইউরোপ এবং হলিউডে সিনেমা তৈরী হয়েছে বহুবার। সবচাইতে আলোচিত ছবিটি তৈরী হয় ১৯৩১ সালে। বিখ্যাত অভিনেত্রী গ্রেটা গার্বো তাতে অভিনয় করেন নাম ভূমিকায়। মাতাহারি ইতিহাসের পাতায় এতোটাই বিখ্যাত যে হল্যান্ড সরকার পরবর্তী সময়ে তার ওপর ডাকটিকেটও প্রকাশ করে।

সূত্রঃ উইকিপিডিয়া, এগিয়ে চলো, কালের কন্ঠ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top