ফিল্ড মার্শাল রোমেল
এরউইন জোহানেস ইউজিন রোমেল (১৮৯১-১৯৪৪) ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান নাৎসি বাহিনীর একজন ফিল্ড মার্শাল। ‘ডেজার্ট ফক্স’ নামে বহুল পরিচিত এই ফিল্ড মার্শাল এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে শুধু তার নিজের বাহিনী নয় যাদের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন সেই মিত্র বাহিনীর কাছেও ছিলেন সম্মানিত।
এর্ভিন রোমেল ১৮৯১ সালের ১৫ নভেম্বরতারিখে জার্মানির দক্ষিণভাগের হাইডেনহাইম শহরে (বর্তমান জার্মান প্রজাতন্ত্রের বাডেন-ভুর্টেমবের্গ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত, বায়ার্নের সীমান্ত সংলগ্ন) জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা যার নিজের নামও ছিল এর্ভিন রোমেল, হাইডেনহাইমের নিকটবর্তী আলেন শহরের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রোটেস্টান্ট প্রধান শিক্ষক ছিলেন। রোমেলের মা হেলেনে ফন লুৎস ছিলেন স্থানীয় এক সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তির কন্যা। রোমেল চার ভাইবোনের মধ্যে ছিল দ্বিতীয়। রোমেলের বাকি ভাইবোনরা ছিল কার্ল, গেরহার্ড ও হেলেনে। রোমেল তার শৈশব স্মরণ করতে গিয়ে লিখেছিলেন যে তার ছেলেবেলা অত্যন্ত আনন্দের মধ্য দিয়ে কেটেছিল।
১৪ বছর বয়সে রোমেল তার এক বন্ধুর সাথে যৌথ প্রচেষ্টায় একটি পরিপূর্ণ গ্লাইডার বানাতে সক্ষম হন যা সীমিত দূরত্বের জন্য উড়তে পারত। শৈশবে রোমেল তার জীবনের লক্ষ্য হিসেবে একজন প্রকৌশলী হওয়াকে স্থির করেছিলেন যা হওয়ার মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন চমকপ্রদ নির্মাণকাজ করবেন। কিন্তু বাবার উৎসাহে রোমেল ১৯১০ সালে স্থানীয় ১২৪তম ভুর্টেমবের্গ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টে একজন অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। সেখান থেকে তিনি উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ডানৎসিশের অফিসার ক্যাডেট স্কুলে প্রেরিত হন এবং তার বিংশতম জন্মবার্ষিকীতে সেখান থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। রোমেল ১৯১২ সালে জার্মান সশস্ত্র বাহিনীতে লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রোমেল ফ্রান্সের রণক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। ইটালি ও রোমানিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রেও তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন। প্রাথমিক ভাবে তিনি ৬ষ্ঠ ওয়ার্টেমবুর্গ পদাতিক রেজিমেন্টের অধীনে যুদ্ধ করলেও অধিকাংশ সময়েই বিশেষ সৈন্যদল আলপেনকর্পসে নিযুক্ত ছিলেন। এই বিশেষ দলে থাকাকালীন তিনি তার বেশ কিছু সামরিক গুণাবলীর জন্য খ্যাতি অর্জন করেন, যেমন তিনি খুব দ্রুত ও দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন এবং শত্রুর বিভ্রমের সুবিধা আদায় করে কৌশল ঠিক করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি তিনবার আহত হয়েছিলেন যার কারণে তিনি সামরিক খেতাব আয়রন ক্রস, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী লাভ করেন। স্লোভেনিয়ার পাহাড়ী অঞ্চলে ইসোনজো যুদ্ধে অবদানের কারণে তিনি প্রুশিয়ার সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব Pour le Mérite ও অর্জন করেন। লোনিয়ারোন যুদ্ধে তিনি তার বাহিনী নিয়ে ইটালির একটি সৈন্যদলকে পরাস্ত করেন। তার ক্ষুদ্র বাহিনীর প্রতিপক্ষ ইটালির বাহিনীটিতে ছিল দেড়শ জন অফিসার, ৯,০০০ এর অধিক সৈন্য ও ৮১টি আর্টিলারি ইউনিট।
ইসোনজোর যুদ্ধে অফিসার রোমেল ইটালির সৈন্যদের হাতে বন্দী হন। কিন্তু তিনি তার সামরিক কৌশলাদি ও ইতালিয় ভাষায় বাকপারদর্শিতার মাধ্যমে মাত্র দুই সপ্তাহর মধ্যে শত্রুদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তার নিজস্ব জার্মান লাইনে ফিরে আসেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন জার্মানরা ইটালির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করল, রোমেল প্রাথমিক ভাবে এতে বিরক্ত হয়েছিলেন কারণ পূর্ববর্তী যুদ্ধ অভিজ্ঞতার দ্বারা ইটালির সৈন্যদের রণকৌশলে, নেতৃত্বে ও দক্ষতায় দূর্বলতার কথা তিনি ভালোভাবে জানতেন।
রোমেল দক্ষিণ জার্মান বা সোয়াবিয়ান টানে জার্মান ভাষায় কথা বলতেন। তিনি তৎকালীন প্রুশিয়ান ক্ষমতা কুক্ষিগতকারীদের দলে ছিলেন না। তিনি জার্মান আর্মিতে “জেনারেল স্টাফ” এর পদ হেলায় ছেড়ে দেন যেটা ছিল সেনা অফিসারদের উঁচু র্যাংকে উঠার সুযোগ। এরচেয়ে তিনি সম্মুখ সমরের অফিসার এর জীবন বেছে নেন। তার যুদ্ধের সময় লেখা ডায়রি মিলিটারি পাঠ্যবই হিসেবে বিবেচিত হত। তার লেখা হিটলার নিজেও খুব পছন্দ করতেন। ১৯৩৫ সালে তিনি ‘যুব হিটলার’ সংগঠনে তরুনদের গড়ে তোলার দায়িত্ব পান। ১৯৩৮ সালে তিনি কর্নেল উপাধি পান এবং একটি যুদ্ধবিদ্যার একাডেমিতে কমান্ডার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
দ্বীতিয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রোমেল ১৯৪০ সালে ফ্রান্স আক্রমনের সময় ৭ পাঞ্জার ডিভিশন কমান্ডার হিসেবে নিজের সুচতুর রণকৌশলের স্বাক্ষর রাখেন। এরপরেই তাকে উত্তর আফ্রিকায় জার্মান ও ইতালী যৌথবাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করা হয়। উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন যুদ্ধের ফলাফল ও রণকৌশল এর কারণে রোমেল দুই বাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য কমান্ডার হিসাবে মর্যাদা লাভ করেন। মরুভূমি যুদ্ধে তার রণকৌশল কিংবদন্তীতুল্য এবং এখনও অনুসরণ করা হয়। এ কারণেই তাকে ‘ডেজার্ট ফক্স’ নামে ডাকা হয়।
ফিল্ড মার্শাল রোমেল এর জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ শুধু তার রণকৌশল না, তিনি ছিলেন জার্মান আর্মির একমাত্র সেনানায়ক যার মধ্যে একই সাথে মানবিক গুণাবলী ও পেশাদারিত্ব বিদ্যমান ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ওয়্যার ট্রাইবুন্যালে কখনই তার বা তার অধীনে থাকা বাহিনী ‘Africa Korps’ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। তার আফ্রিকা যুদ্ধাভিযানের সময আটককৃত মিত্র বাহিনীর সৈনিকদের সাথে মানবিক আচরণ করা হয়েছে বলে পরবর্তীতে রিপোর্ট করা হয়েছিল। হিটলারের দেয়া ইহুদি সেনা, বেসামরিক নাগরিক ও কমান্ডোদের নির্বিচারে হত্যা করার আদেশ তিনি উপেক্ষা করেন।
১৯৪৪ সালের শুরুর দিকে তিনজন – কার্ল স্ট্রলিন, আলেকজান্ডার ভন ফালকেনহিউসেন এবং কার্ল হাইনরিখ ভন স্টুল্পনেগেল – হিটলারকে হত্যার পরিকল্পনা গ্রহন করেন। তারা এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে রোমেলকে আনতে চেষ্টা করেন। কারণ তারা জানতেন এই ষড়যন্ত্র কে জনগনের কাছে গ্রহনযোগ্য করতে হলে জার্মানির সবচেয়ে জনপ্রিয় সেনা কর্মকর্তার এর পক্ষে অবস্থান অনেক বড় ভূমিকা পালন করবে। নাৎসি বাহিনীর চীফ অব ষ্টাফ হান্স স্পাইডেল রোমেল ও ঐ তিনজনের মধ্যে বৈঠকের আয়োজন করেন। আরও কিছুদিন যোগাযোগের পর ফেব্রুয়ারির কোন এক সময়ে রোমেল এই ষড়যন্ত্রে তার সমর্থন দিতে রাজি হন হিটলারকে হত্যা নয় উৎখাত করা হবে এই শর্তে। কারণ তিনি মনে করতেন হিটলারকে হত্যা করা হলে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে এবং হিটলার একজন জাতীয় বীর হিসেবে পরিচিতি পাবেন। তাঁর পরিকল্পনা ছিল হিটলারকে গ্রেপ্তার করা এবং বিচারের সম্মুখীন করা।
কিন্তু রোমেলের অগোচরে ২০ জুলাই ১৯৪৪ এ হিটলারকে হত্যার জন্য একটি ব্যর্থ বোমা হামলা চালানো হয়। এই বোমা হামলার পর পরই অনেক ষড়যন্ত্রকারী গ্রেফতার হতে থাকে। এদেরই মধ্যে কার্ল হাইন্রিখ ভন স্টুল্পনেগেল ক্রমাগত অত্যাচারের পর রোমেলের জড়িত থাকার কথা ফাঁস করে দেন।
জার্মানীর সাধারণ মানুষের কাছে রোমেল ছিলেন একজন জাতীয় বীর। এই ধরনের একজনকে প্রকাশ্য জনসমক্ষে ফাঁসী বা ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা ছিল হিটলারের জন্য একটি দুরহ কাজ। হিটলার জানতেন রোমেলের এ ধরনের মৃত্যু জনগণের মনোবল ভেঙে দেবে এবং তাঁর নিজের অবস্থান ও নড়বড়ে হয়ে যাবে। কাজটি অন্যভাবে সম্পন্ন করার জন্য হিটলার ও উইলহেম কিটেল একটি পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী হিটলারের কাছের দুজন জেনারেল রোমেলের বাসায় গিয়ে তাঁর অপরাধ পড়ে শোনান এবং আত্মহত্যা ও সামরিক আদালতে বিচারের যে কোন একটিকে বেছে নিতে বলেন। তারা তাকে এটাও বলে দেন যদি তিনি বিচারের সম্মুখীন হতে চান তাহলে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর অধনস্তদেরকেও গ্রেফতার ও হত্যা করা হবে এবং তাঁর পরিবারকে অত্যাচার করা হবে তাদের মৃত্যুদন্ডের আগ পর্যন্ত। আর তিনি যদি আত্মহত্যা করেন তাহলে তাঁর পরিবারকে তাঁর মৃত্যুর পর কোন অত্যাচার করা হবে না সেই নিশ্চয়তার দেয়া হয়। কিছুক্ষন পর রোমেল তাঁর পরিবারকে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত জানান এবং একটি মাঠে গিয়ে আগে থেকেই নিয়ে আসা একটি সায়ানাইড ক্যাপস্যুল খেয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
তার মৃত্যুতে হিটলার একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।
রোমেলের মৃত্যুর কারণ হিসেবে যুদ্ধে পুরাতন ক্ষতের ইনফেকশনের কথা বলা হয়। যুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে রোমেলের স্ত্রী রোমেলের মৃত্যুর আসল কারণ বলেন। যদিও অনেকে তখন এটা অবিশ্বাস করেন। কিন্তু ১৯৫৯ নুর্যেম্বার্গ ট্রায়ালের সময় এই পরিকল্পনয়ায় হিটলারের মুল সাহায্যকারী উইলহেম কিটেল এই ঘটনার সত্যতা এবং বিস্তারিত জানান।
হিটলারের জেনারেলদের মধ্যে একমাত্র রোমেল এর নামে একটি যাদুঘর স্থাপন করা হয়। তাঁর সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে তাঁর সাথে যুদ্ধ করেছেন যারা তারা যেমন গিয়েছেন, তেমনি গিয়েছেন যারা তাঁর বিপক্ষে যুদ্ধ করেছেন।
সূত্রঃ
- উইকিপিডিয়া
- সামহোয়ার ইন ব্লগ