ক্রিস্টিনা গ্র্যানভিলিঃ চার্চিলের প্রিয় নারী গোয়েন্দা হয়ে উঠেন যিনি

ক্রিস্টিনা গ্র্যানভিলি

চার্চিলের প্রিয় নারী গোয়েন্দা হয়ে উঠেন যিনি

কথিত আছে, জনপ্রিয় জেমস বন্ড সিরিজের অমর স্রষ্টা ইয়ান ফ্লেমিং তার প্রথম বইয়ের একটি চরিত্র ভেসপার লিন্ড সৃষ্টির অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন ক্রিস্টিনার জীবন থেকে। এক দূরন্ত বৃটিশ স্পাই। গোয়েন্দা কর্মকান্ডে সফলতার জন্য যিনি উইন্সটন চার্চিলের সবচেয়ে পছন্দের গোয়েন্দাদের তালিকায় স্থান করে নেন।
 
কে এই ক্রিস্টিনা? ক্রিস্টিনা হচ্ছেন পোল্যান্ডের এক অভিজাত ব্যক্তির আদুরে কন্যা। তার জন্ম ১ মে ১৯০৮ সালে পোল্যান্ডের ওয়ারসো শহরে। ক্রিস্টিনা ছোট বেলা থেকে উচ্চবিলাসী জীবন যাপন পছন্দ করতেন। নিজেও ছিলেন অতি মাত্রায় সুন্দরী। ১৯৩০ সালে ক্রিস্টিনা মিস পোলোনিয়া কন্টেস্টের নৃত্য অভিনয়ে অংশগ্রহণ করে ৬ষ্ঠ স্থান অধিকার করেন। পারিবারিকভাবে ক্রিস্টিনার কারোল গেটলিচ এর সাথে বিবাহ হলেও তা টেকেনি বেশিদিন। ১৯৩৮ সালে জার্জি গিজেচকির সাথে সাক্ষাত হলে তার প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করেন ক্রিস্টিনা। তারা দুজনেই যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তর হন।  
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ক্রিস্টিনা সাথে সাথেই  ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগে ঢুকে পড়ে, তখন এমনকি এসওই (SOE) আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিতই হয়নি।

বিলাসব্যসনে অভ্যস্ত এ মেয়েটি গোয়ান্দাগিরির দায়িত্ব পেয়ে প্রথমে হাঙ্গেরিতে কিছুদিন অবস্থান করেন। সেখানে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে এক পা হারানো পোলিশ ওয়ার হিরো আন্দ্রজেজ কোয়ারস্কির সাথে পরিচয় ঘটে। তাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব ঘটায় ক্রিস্টিনা তার থেকে অনেক কিছু শিখতে পারেন। কোয়ারস্কির পরামর্শে ক্রিস্টিনা তখন নিজের নাম পরিবর্তন করে ক্রিস্টিনা গ্র্যানভিলি ছদ্মনাম রাখেন। পরিবর্তে তিনি এ নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

গোয়ান্দা তৎফরতার অগ্রগতিতে তিনি হাঙ্গেরি থেকে চোরাইপথে পোল্যান্ডে ঢুকে পড়েন। কিন্তু কাজটি এত সহজ ছিল না। মাইনাস ৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পর্বতমালা অতিক্রম করা পৃথিবীর কঠিনতম কাজগুলোর একটি। সে কাজটি করে ক্রিস্টিনা পা রাখেন পোল্যান্ডে। যোগাযোগ করেন অন্যান্য এজেন্ট ও প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সাথেও।
ক্রিস্টিনা পোল্যান্ড পৌঁছে যে কাজটি গুরুত্বের সাথে শুরু করেন তা হলো পোলিশ বিমানসেনাদেরকে নিরপেক্ষ যুগোস্লাভিয়ায় পাচার। যাতে তারা মিত্রশক্তির বিমানবাহিনীতে যোগ দিতে পারে।
তার বিশেষত্ব ছিল কোন পথে সেনাসদস্যরা কখন পার হবে সে সম্পর্কে নিখুঁত তথ্য সংগ্রহ করে পাঠানো। তার দেওয়া তথ্য ধরেই হামলা পরিচালনা করা হতো। ক্রিস্টিনা গ্র্যানভিলির তথ্য ছিল নির্ভুল। চুরি করে তিনি নিজেই ছুটে যেতেন তথ্য পৌঁছে দিতে। তথ্য নিয়ে পালানোর সময় তিনি প্রায়ই শত্রুদের কাছাকাছি পড়ে যেতেন, শত্রুপক্ষের নজরে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও অকুতোভয়ী এই নারী তথ্য পৌছে দেয়ার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করে যেতেন।

১৯৪১ সালের একদিনে শত্রুর হাতে ধরা পড়ে যান ক্রিস্টিনা। গেস্টাপোর হাতে বন্দি হওয়ার ভয়াবহ ফলাফল সবারই জানা।  ধরা পড়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আটককারীকে জানান, তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত। প্রমাণ হিসেবে নিজের জিহ্বা কামড়ে রক্ত বের করে কাশি দিয়ে কফ ও রক্ত দেখান আটককারীকে। যুদ্ধের আগে একটি গাড়ির কারখানায় কাজ করার সময় তার ফুসফুসে কিছু কাটা দাগ পড়ে। তার এক্স-রে রিপোর্টও দেখান তিনি।

এই কৌশল ভালো কাজ দেয়। ছাড়া পেয়ে যান ক্রিস্টিনা। ছাড়া পেয়েই সোজা ইংল্যান্ড চলে যান। এতেই তার গোয়ান্দা কার্যক্রম থেমে যায়নি। ১৯৪৪ সালে তাকে পাঠানো হয় ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে। দায়িত্ব পড়ে ফরাসি ও ইতালীয় প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মধ্যে লিয়াজোঁ করার।
এখানেও তিনি অনেক কৃতিত্ব দেখান। এর একটি হচ্ছে ৬০০ মিটার উঁচু পথ পাড়ি দিয়ে একটি দুর্গে পৌঁছা এবং সেখানকার ২০০ সেনাকে আত্মসমর্পণে রাজি করানো। এসময়েই গোয়েন্দা হিসেবে চার্চিলের নজরে পড়েন তিনি, চার্চিল তার সাহসিকতার জন্য তাকে গোয়েন্দাদের মধ্যে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করেন।   আরেকবার তিনি ফিল্ড মার্শাল মন্টোগোমারির ভাতিজি সেজে এক জার্মান গেস্টাপো অফিসারকে রাজি করিয়ে তিন সহকর্মীকে মুক্ত করে আনেন। ছাড়িয়ে আনতে না পারলে সেখানেই ওদের মৃত্যুদণ্ড হতো।

যুদ্ধের পর তাকে জর্জ মেডেল ও ওবিই পুরষ্কার দেয়া হয়। কিন্তু ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পেতে দেরি হওয়ায় তিনি হয়ে পড়েন দেশহীন। তার হাতে তখন অর্থও তেমন ছিল না। এ সময় তিনি এক ধরনের ছন্নছাড়া জীবনযাপনে বাধ্য হন। একপর্যায়ে একটি সমুদ্রগামী জাহাজে স্টুয়ার্ডসের পদে জয়েন করেন। ১৯৫২ সালে লন্ডনের একটি হোটেলের কক্ষে তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে একজন পোর্টার (কুলি)। কারণ, তিনি তাকে পদোন্নতি দিতে অস্বীকার করেছিলেন।

তথ্যসূত্রঃ

  • https://en.wikipedia.org/wiki/Krystyna_Skarbek
  • https://allthatsinteresting.com/krystyna-skarbek
  • https://www.notablebiographies.com/supp/Supplement-Fl-Ka/Granville-Christine.html

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top