ফিলিস লেট্যুর ডয়লে
দ্য হেয়ারব্যান্ড স্পাই
নিউজিল্যান্ডের ওয়েস্ট অকল্যান্ডের এক বৃদ্ধাশ্রমে বসবাসরত পিপ্পা ডয়লে এতদিন হোমের অন্যদের চোখে তাদের মতোই সাধারণ একজন ছিলেন। ৯৩ বছর বয়স তার। মিষ্টি স্বভাবের মানুষ। মাথায় বরফের মতো সাদা চুল। পেনশন পান। চার সন্তানের জননী। এই তো, এর মধ্যে ‘অসাধারণত্বের’ আর কী থাকতে পারে!
হঠাৎ সব ধারণা পরিবর্তন হয়েগেলো ২০১৪ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসে। ফ্রান্স সরকার হঠাৎ করে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব লিজিয়ন অব অনারে ভূষিত করলো। তাও না হয় মেনে নেয়া যেতো, কিন্তু যে কারণে তার এ সম্মান, তা শুনে হোমের বাসিন্দারা যেন ঢোক গেলার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেললো। পিপ্পা খেতাবটি পেয়েছেন ১৯৪৪ সালে অধিকৃত নরম্যান্ডিতে ব্রিটিশ গুপ্তচর হিসেবে দুর্ধর্ষ ভূমিকা রাখার জন্য। নিজের এই গোপন ও গৌরবময় অতীত নিয়ে তিনি কখনো একটি শব্দও বলেননি, এমনকি কখনো কোথাও এ বিষয়ে কথা উঠলেও সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছেন সম্ভ্রান্ত এই নারী।
পিপ্পা ডয়লে বা মিসেস ডয়লের আসল নাম ফিলিস লেট্যুর। তার পিতা ছিলেন ফরাসি, মা ইংরেজ। পিপ্পার বয়স যখন খুব কম, তখনই তারা মারা যান। পিতা ও মাতার সুবাদে ফরাসি ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই অনর্গল কথা বলতে পারতেন পিপ্পা। মাত্র ২০ বছর বয়সে ফ্লাইট মেকানিক হিসেবে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য ব্রিটেনের উইম্যান’স অক্সিলিয়ারি এয়ারফোর্সে যোগ দেন পিপ্পা। ফরাসি ভাষায় দক্ষতা তাকে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে খানিকটা এগিয়ে দেয়। আনআর্মড কমব্যাট, ওয়েপনস ড্রিল ও মোর্স কোড বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় অধিকৃত ফ্রান্সে।
১৯৪২ সালে পিপ্পাকে পাঠানো হয় ফ্রান্সের অ্যাকুইটাইনে। তার বয়স যখন ২৩, তার কিছুদিন পরেই অর্থাৎ ১৯৪৪ সালের ১ মে তাকে প্যারাসুটে করে ফেলা হয় নরম্যান্ডিতে নাৎসি বাহিনীর ঘাটির ঠিক পেছনের দিকে। এবার সে হয়ে যায় ২৩ বছর বয়সী একজন ফরাসি বালিকা। তার ছদ্মনাম হয় পাউলেত। একটি সাইকেলে চড়ে অন্য সব ফরাসি মেয়ের মতো সেও দখলদার জার্মান সৈন্যদের কাছে সাবান বিক্রি করতে শুরু করে, এমনকি জার্মান সৈন্যদের নিকটে গিয়ে তাদের সাথে গল্পও জূটে দেন। জার্মান সৈন্যরা কল্পনাও করতে পারে না, এই ছোট মিষ্টি মেয়েটি আসলে একজন ব্রিটিশ স্পাই। সাবান বিক্রির ছদ্মাবরণে মেয়েটি ঘুরে ঘুরে দেখে নেয় দখলদার সৈন্যদের পজিশন ও মুভমেন্ট। তারপর তা জানিয়ে দেয় ফরাসি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের, আর গোপন রেডিওর সাহায্যে খবর ট্রান্সমিট করে ব্রিটেনে। পিপ্পা তার সংগ্রহ করা কোডেড বার্তাগুলো জুতার ফিতায় বুনে হেয়ারব্যান্ড হিসেবে ব্যাবহার করে তা দিয়ে চুল বেঁধে হাটতেন, চলতেন। যুদ্ধের শেষদিকে সেসময়ে পিপ্পা ১৩৫ টা কোডেড বার্তা পাঠায় বৃটিশ মিলিটারির কাছে।
এ সময় পিপ্পা থাকতো বনের ভেতরে, যাচ্ছেতাই রকমের একটা কুঁড়েঘরে। বেঁচে থাকার জন্য ইঁদুর ধরে খেতো আর ভেতরে ভেতরে কেবলই ভয়ে কাঁপত, যদি ধরা পড়ে যাই! রেডিও ট্রান্সমিটারে বার্তা পাঠানো মাত্রই পিপ্পা তার স্থান পরিবর্তন করে নিতেন, কিংবা দূরের গভীর জঙ্গলে গিয়ে বৃটিশদের কাছে বার্তা পাঠাতেন, যাতে জার্মান গোয়েন্দা সংস্থা রেডিও সিগনাল ধরে তার কাছে পৌঁছাতে না পারে।
বছর ১৫ আগে নিজের জীবনের এই গোপন অধ্যায়টি পিপ্পা প্রথম বলেন তার সন্তানদের কাছে। ২০০৯ সালে নিউজিল্যান্ডের আর্মি নিউজ ম্যাগাজিনকে জানান কেন ও কিভাবে তিনি ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এসওই’র স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছেন। পিপ্পা কোনো রাখঢাক না করেই জানান, নেহায়েত প্রতিশোধ নেয়ার উদ্দেশ্যেই তিনি এ কাজে জড়ান। কারণ, শৈশবে পিতৃ-মাতৃহীন পিপ্পাকে যে নারী মাতৃস্নেহে লালনপালন করেছিলেন, তার পিতাকে গুলি করে হত্যা করে জার্মানরা আর মাতাকে ধরে নিয়ে যায়। জার্মানদের হাতে বন্দী হয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। এর বদলা নিতেই পিপ্পা ব্রিটেনের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তিতে নামেন।
স্পাই হলেও নারীসত্ত্বাটি সতত সক্রিয় ছিল পিপ্পার ভেতরে। একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে সেটি স্পষ্ট হয়। একবার তার পাঠানো বার্তার সূত্র ধরে একটি জার্মানভাষী এলাকায় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। পরে পিপ্পা জানতে পারেন, ওই হামলায় এক জার্মান নারী ও দু’টি শিশুও নিহত হয়েছে। শুনে বিষাদে ছেয়ে যায় তার মন। তিনি ভাবতে থাকেন, এই মৃত্যুর জন্য তো পরোক্ষভাবে আমিও দায়ী। পরে তিনি তাদের শেষকৃত্যে অংশ নেন।
যুদ্ধ শেষ হলে দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্মগ্রহণকারী পিপ্পা এক অস্ট্রেলিয়ান ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করেন এবং কখনো ফিজি, কখনো অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করতে থাকেন। পরে নিউজিল্যান্ডে স্থায়ী হন।
- https://www.rejectedprincesses.com/blog/modern-worthies/phylis-latour-doyle