ইতিহাসের নির্মম এক অধ্যায় – আমেরিকার দাসপ্রথা

আমেরিকার দাসপ্রথা

সভ্যতার খুব শুরু থেকেই দাসপ্রথা পৃথিবীতে প্রচলিত ছিল। মেসোপোটেমিয় সভ্যতায় সর্বপ্রথম দাসব্যবস্থার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তারো পরে সম>য়ে সময়ে দাসপ্রথা নানান আঙ্গিকে ইতিহাসে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। প্রাচীন ও মধ্যযুগের রাজ রাজড়াগণ শখের বশে ক্রীতদাস রাখত, কাউকে খোজা বানিয়ে রেখে দিত অধিকতর আনুগত্যের আশায়৷ কিন্তু আধুনিক পৃথিবীর যে ‘দাসপ্রথা’ বা স্ল্যাভারি সেটি ছিল ইতিহাসের অন্য এক অধ্যায়। যে অধ্যায়ের দিকে চোখ ফুরালে সভ্য দুনিয়ার মানুষজন মুখ লুকাতে বাধ্য হয়। আমেরিকা আবিষ্কারের পর দাসপ্রথা এক রমরমা ব্যবসায় পরিণত হয়। শ্বেতাঙ্গদের চাহিদা মেটানোর জন্য আফ্রিকা থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ধরে এনে আমেরিকায় বিক্রি করে দেয়া হত। অমানবিক অত্যাচার আর অমানুষিক পরিশ্রমের বদলে মালিকপক্ষ খুব সামান্যই প্রাপ্য বুঝিয়ে দিত সেইসব অসহায় দাসদের।

আমেরিকায় দাসপ্রথার উত্থান  হয় যেভাবে

আমেরিকায় দাসপ্রথার উদ্ভব ঘটে ষোড়শ শতকের শেষ ও সপ্তদশ শতকের শুরুতে ঔপনিবেশিক আমলে। ব্রিটেন যখন আমেরিকায় নিজেদের উপনিবেশ কায়েম করে তখন অর্থকরী ফসলের উৎপাদন কাজে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন দেখা দেয়। কৃষি ব্যবস্থা উন্মেষের সাথে সাথে আমেরিকায় কৃষি শ্রমিকের চাহিদা হুহু করে বাড়তে থাকে। আর এই উপযোগিতাকে ঘৃণ্যভাবে ব্যবহার করে ব্রিটিশ, স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ বণিক গোষ্ঠী আমেরিকার বাজারে দাস বিক্রি শুরু করে। এই দাসরা সবাই ছিল আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ।  কম মূল্যের এই মানুষগুলো নির্দয়ভাবে নিজের স্বাধীনতা খুইয়ে জোরপূর্বক বিক্রি হয়ে যেত।

পেশাদার দাস ব্যবসায়ীরা অনেক পথ পাড়ি দিয়ে নদী বা সমুদ্রপথের ভাটি অঞ্চল থেকে আমেরিকার দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে দাস প্রেরণ করতে থাকে। আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলে দাসপ্রথা খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে পড়ে। এই অঞ্চলের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর হওয়ায় ভূমি মালিকরা সস্তায় দাস কিনে নিজেদের জমির ফসল উৎপাদনে লাগিয়ে দিত। ভার্জিনিয়ায় সর্বপ্রথম দাসপ্রথা গৃহীত হয় যা পরে অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। ঔপনিবেশিক আমেরিকায় দাসপ্রথার কাঠামোগত প্রাতিষ্ঠায়ন হয় আঠারো শতকের শেষ দিকে। এসময় ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয়। ফলে বস্ত্রশিল্পের বিকাশ ঘটে। এই কারণে  কাচামাল হিসেবে তুলার দাম ও চাহিদা দুটোই বেড়ে যায়। উচ্চভূমি এবং মালভূমি অঞ্চলের তুলা বীজের সাথে আঠা লেগে থাকত এবং বীজ থেকে আঁশ ছাড়ানো শ্রমসাপেক্ষ ছিল। ফলে এই কাজে সহজলভ্য কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের নিয়োগ দেয়া হয়। দাসপ্রথাকে আইন দ্বারা স্বীকৃতি দেয়া হয় এই সময়ে। সম্পদের লোভে যারা আমেরিকায় এসে ঘাটি গেড়েছিল তারা এখানে এসে বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হয়। নিজেদের জমি পরিষ্কার, বাড়ি তৈরি, ফল ফলাদি উৎপাদন কাজে ব্যাপক কায়িক পরিশ্রমের দরকার পড়ত। এরা নিজেদের প্রয়োজনে দাসদের লুফে নেয়। ঔপনিবেশিক সরকার আমেরিকায় মনিব-ভৃত্যের মধ্যকার সম্পর্ককে আইনের মাধ্যমে পাকাপোক্ত করে। এই আইনের ফলে চাইলেও ভৃত্যরা পালিয়ে যেতে পারত না। আর যদিবা পালিয়েও যেতো পুনরায় তার মালিকের কাছে ফিরে আসতে বাধ্য থাকত। তবে এ আইনের একটি ভাল দিল ছিল যে  চুক্তি শেষে দাস রা মুক্ত হতে পার‍ত। খুব শীঘ্রই দাসপ্রথা সমগ্র ব্রিটিশ উপনিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৬১৯ সালে একটি ওলন্দাজ জাহাজে করে ভার্জিনিয়ায় ২১ জন কৃষ্ণাঙ্গ বিক্রির মাধ্যমে ব্যবসায়িকভাবে সর্বপ্রথম দাসব্যবসার সূচনা হয়।

কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের মানবেতর জীবন

ঔপনিবেশিক আমলে দাসপ্রথার পুরোটা আবর্তিত হয়েছিল আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গদের কেন্দ্র করে। মূলত জোরপূর্বক চুরি করে বা অপহরণের মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ীরা আফ্রিকা থেকে মুক্ত মানুষদের ধরে এনে আমেরিকায় দাস হিসেবে বিক্রি করে দিত।

ইউরোপীয় সাদারা নিজেদের অনুগত চরদের মাধ্যমে এসব কৃষ্ণাঙ্গদের কব্জা করত। অনেক সময় গ্রামবাসীদের অতর্কিত আক্রমণ করে, আগুন জ্বালিয়ে এলাকা দখল করত এরা এবং সেইসব এলাকা থেকে তাদের শিকার কৃষ্ণাঙ্গদের ধরে নিয়ে যেত। বন্দিদের গলায় চামড়ার ফিতে বেঁধে গরুর পালের মত মারতে মারতে গন্তব্যে হাজির করত। এসব বন্দিদের প্রায়ই নিয়ে যাওয়া হত দাসব্যবসার পীঠস্থান গাম্বিয়া নদীর তীরে যেখানে ব্যবসায়ীরা অপেক্ষা করত। বন্দিদের রাখা হত বাঁশের খাচায় কঠিন পাহারায়। বিক্রির আগে তাদের চুল কামানো হত। গায়ে তেল মাখানো হত। হতভাগ্য এসব আফ্রিকানদের তখন নিজের নাম ভুলে যেতে হত। নতুন নাম নিয়ে মালিকপক্ষ তার পছন্দের দাসটিকে পিঠে গরম লোহার শিক দিয়ে চিহ্নিত করে নিয়ে যেত। ক্রয়কৃত দাসদের এরপর তুলা হত বিশেষ শ্রেণীর জাহাজে। গাদাগাদি করে যাওয়ার পথে অনেক দাস যাত্রাপথেই মারা যেত। যারা জীবিত থাকত তাদের চড়ামূল্যে বিক্রি করে ব্যবসায়ীরা ক্ষতি পুষিয়ে নিত। মালিকের কাছে যাওয়ার পর পুরোপুরিভাবে প্রায় সারাজীবনের জন্য দাসরা নিজেদের স্বাধীনতা হারাতো। চাকর, কারিগর, বাবুর্চি, নার্স, কামার, ছুতোর, মিস্ত্রি ইত্যাদি কাজে দাসরা নিয়োজিত হত নিজেদের দক্ষতা অনুসারে। অনেক দাস নিজেদের পেশাগত দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। দক্ষিণাঞ্চলে দাসদের সম্পত্তির অধিকার, অনুমতি ছাড়া মালিকের ঘরে প্রবেশ, চার্চ ছাড়া অন্য কোথাও সমবেত হওয়া, আত্মরক্ষায় শ্বেতাঙ্গকে আঘাত, লেখাপড়া নিষিদ্ধ ছিল। আদালতে শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গদের সাক্ষ্য দেয়া নিষিদ্ধ ছিল। নির্যাতনে দাস মারা গেলে মালিকের কোন বিচার হত না। তাদের চলাফেরা পর্যবেক্ষণের জন্য রাতে অশ্বারোহী প্রহরী টহল দিত।

দাসপ্রথার বিলুপ্তি

আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চল কৃষিনির্ভর হওয়ায় এখানে দাসদের চাহিদা ছিল বেশি। অন্যদিকে উত্তরাঞ্চল শিল্পপ্রধান হওয়ায় সে অঞ্চলে দাসব্যবসা ছিল সামান্যই। উত্তরাঞ্চলের অধিবাসীরা এই ব্যবস্থাকে একটি সামাজিক ব্যাধি বলে মনে করত। ফলে উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে আদর্শের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। একটা সময়ে এসে দাসপ্রথা নিয়ে আমেরিকায় রাজনৈতিক সমস্যা দেখা দেয়। এই প্রথা বিলোপ নিয়ে দুই অঞ্চলের মধ্যকার সম্পর্ক তিক্ততায় রূপ নেয়।আরো কিছু রাজনৈতিক মিলিয়ে ১৮৬১ সালে দেখা দেয় আমেরিকার গৃহযুদ্ধ। অবশেষে এই গৃহযুদ্ধের মাঝেই আসে ঐতিহাসিক ঘোষণা। ১৮৬২ সালে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন দাস মুক্তির ঘোষণা পত্র প্রচার করেন। এতে বলা হয় ১৮৬৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সকল দাস মুক্ত নাগরিক বলে গণ্য হবেন এবং কৃষ্ণাঙ্গরা যুক্তরাষ্ট্রের সম্মানিত নাগরিক হিসেবে সকল ধরণের অধিকার ভোগ করবেন। আর এরই সাথে সমাপ্ত হয় আমেরিকা তথা বিশ্ব ইতিহাসের কুখ্যাত প্রথা স্ল্যাভারি।

তথ্যসূত্র

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস- অধ্যাপক শরিফ উল্লাহ ভূঁইয়া, অধ্যাপক সামিনা সুলতানা https://www.google.com/amp/s/www.history.com/.amp/topics/black-history/slavery

– সংগৃহীত

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top