ইতিহাসের বর্বরোচিত ৪ গণহত্যা

ইতিহাসের বর্বরোচিত ৪ গণহত্যা

গণহত্যা শব্দটি শুনলেই চোখে ভেসে উঠে লাশের সারি সারি স্তুপ, মারণাস্ত্রের গগণবিদারী চিৎকার, মানুষের দম ফাটা আর্তনাদ। রাজনৈতিক এবং ঔপনিবেশিক ইত্যাদি নানা কারণে একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর উপর গণহত্যার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেহাতপক্ষে কম নয়। এই বদ্বীপের সোঁদা মাটি থেকে বসনিয়া, আর্মেনিয়া হয়ে কুর্দিশ কিংবা হলোকাস্ট গণহত্যা আজো বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে রেখেছে। কোন গণহত্যা পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, কোনোটা পায়নি। কোনোটা বা সম্পাদন হয়ে গেছে নিরবে নিভৃত। ইতিহাসের সেই নৃশংসম গণহত্যা নিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের আজকের ফিচার।

হলোকাস্ট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান নাজি বাহিনী দ্বারা গণহারে ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যা ইতিহাসে পরিচিত হলোকাস্ট নামে। ১৯৩৯ সালে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তার আগ থেকেই হিটলারের নাজি বাহিনী ইহুদিদের উপর নির্যাতন শুরু করে দেয়।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই জার্মানি থেকে  থেকে ইহুদিদের বিতাড়নের জন্য  আইন প্রণয়ন করা হয়। জনাকীর্ণ বন্দী শিবিরে রাজনৈতিক ও যুদ্ধবন্দীদেরকে ক্রীতদাসের মতো কাজে লাগাতো তারা। যারা পরে অবসন্ন হয়ে রোগভোগের পর মারা যেত।বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে জার্মান বাহিনী সফলতা লাভ করলে ইহুদিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দেয়। ১৯৪১ সালে হিটলারের বাহিনী ইউরোপের কয়েকটি দেশ দখল করে নিলে প্রাণ বাঁচাতে ইহুদিরা প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে যেতে থাকে। নাজি বাহিনীরা যাকে পারে তাকে পোল্যান্ড ও জার্মানির কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে রেখে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায়। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ইহুদিগহ নাগরিকদের। উগ্র জাতীয়তাবাদী জার্মান বাহিনীর এতোটাই ইহুদি বিদ্বেষ ছিল যে, তারা ঐ সময়কার ইউরোপের প্রায় অর্ধেক ইহুদি জনসংখ্যা গণহত্যা চালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়। এই গণহত্যায় প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি নিহত হয়। হলোকাস্টের দুঃসহ স্মৃতি রক্ষার্থে জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রতিবছরের ২৭ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক হলোকাস্ট দিবস পালন করা হয়।

রুয়ান্ডার গণহত্যা

নির্মমতার বিচারে হলোকাস্ট গণহত্যার পর ইতিহাস সাক্ষী হয়েছে আরেকটি নৃশংসতম গণহত্যার। একে হত্যাকাণ্ড না বলে রুয়ান্ডার গৃহযুদ্ধ বলাই শ্রেয়। ঘটনার সূত্রপাত মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে, বেলজিয়াম যখন রুয়ান্ডা দখল করে নেয়। জাতিগতভাবে রুয়ান্ডার নাগরিকরা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। হুটু ও টাটসি নামের এই দুই শ্রেণীর মধ্যে সংখ্যাগুরু ছিল হুটুরা। টাটসিরা সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও বেলজিয়ান সরকার তাদের প্রাধান্য দেয়া শুরু করে এবং রুয়ান্ডার নাগরিকদের আলাদা জাতিসত্তার পরিচয়পত্র প্রদান করে স্পষ্ট সাম্প্রদায়িক রেখা টেনে দেয়। ১৯৬২ সালে বেলজিয়ানরা চলে গেলে রুয়ান্ডা স্বাধীন হয় এবং স্পটলাইটে চলে আসে হুটুরা। এসময় নির্যাতনের ভয়ে অনেক টাটসিরা পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে যায়। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা হুটুরা বাস্তবিকই টাটসিদের উপর অত্যাচার চালাতে থাকে। হুটুদের প্রেসিডেন্ট আক্ষরিক অর্থেই টাটসিদের উপর নির্যাতনের বুলডোজার চালান। নির্যাতিত টাটসিরা এবার  সশস্ত্র টিম গঠন করে চোরাগুপ্তা হামলা চালাতে থাকে। হুটুরা এবার আরো নির্দয় হয়। ১৯৯৪ সালে মাত্র ৩ মাসের ব্যবধানে হুটুরা প্রায় ৮ লক্ষ লোক হত্যা করে। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প খুলে বন্দি টাটসি নারীদের ধর্ষণ এবং পুরুষদের অমানবিক জুলুম চালায়। গণহত্যা চলে ২০০৩ সাল পর্যন্ত। এই সময় পর্যন্ত প্রায় ৫০ লাখ রুয়ান্ডার নাগরিক নিহত হয়।

আল আনফাল ক্যাম্পেইন

১৯৮০ সালে শুরু হওয়া ৮ বছরব্যাপী নিস্ফল ইরান-ইরাক যুদ্ধের মধ্যসময়ে ইরাকি বাহিনী কর্তৃক স্বাধীনতাকামী কুর্দিদের উপর চালানো গণহত্যা ইতিহাসে আল আনফাল ক্যাম্পেইন বা কুর্দিশ গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। ১৯৮০ সালে সাদ্দাম হোসেনের ইরাক বাহিনী  ইরান আক্রমণ করলে দুই দেশের মধ্যে এক বিরতিহীন ফলবিহীন যুদ্ধের অবতারণা হয়। যুদ্ধের শেষের দিকে এসে ইরাকি বাহিনী কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ইরাক সরকারের ব্যস্ততার সুযোগে স্বাধীনতা প্রত্যাশী কুর্দি জনগণ বিদ্রোহ করে বসে এবং এই বিদ্রোহীদের সরাসরি সহায়তা প্রদান করে ইরান। ইরানের সামরিক বাহিনী এবং কুর্দি মিলিশিয়াদের সম্মিলিত আক্রমণে প্রায় ব্যতিব্যস্ত ইরাকি বাহিনী এবার মরণখেলায় মেতে উঠে সাধারণ কুর্দিদের সাথে। কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলে রাসায়নিক বোমা হামলা চালায় ইরাকি বাহিনীরা। কোন ধরণের বাছবিচার ছাড়াই গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায় নিরীহ কুর্দিদের লাশ। এই গণহত্যায় ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ কুর্দিশ জনগণ নিহত হয়।

কম্বোডিয়ার গণহত্যা

মাওবাদী গ্রুপ খেমাররুজ সরকার দ্বারা কম্বোডিয়ায় চালানো ব্যাপক হত্যা ইতিহাসের আরেক কালো অধ্যায়। ১৯৭৫ সালে খেমাররুজরা যখন কম্বোডিয়ায় সরকার গঠন করে তার পরবর্তী ৪ বছর নানান ছুতোয় প্রায় ২০ লক্ষ সাধারণ লোককে তারা হত্যা করে। পূর্বতন সরকারের পক্ষে কাজ করা কর্মকর্তা কর্মচারীদের হত্যা এবং গুমের মাধ্যমে প্রায় নিরবে নিভৃতে এই গণহত্যার সূচনা করে এই মাওবাদী গ্রুপ। এছাড়া সরকারের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করলেই নানান বাহানায় এদের হত্যা করা হত৷ অবস্থা এমন এক পর্যায়ে চলে যায় যে , সরকারের অভ্যন্তরে এই হত্যাখেলা শুরু হয়ে যায়। শুধুমাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তারা একে অপরকে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে এক অবিশ্বাসের খেলায় জড়িয়ে পড়ে। অবশেষে ভিয়েতনামের কাছে খেমাররুজ সরকার উৎখাত হলে এই গণহত্যা বন্ধ হয়।

নিষ্ঠুর যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা আর অস্ত্রের ব্যবসার বলির পাঁঠা হওয়া সাধারণ জনগণ সবসমই ভুক্তভোগী। তাদেরকে কখনো মূল্য দিতে হয় ঘরবাড়ি, জন্মভূমি হারিয়ে কখনোবা গণহত্যার শিকার হয়ে। শান্তিবাদী মানুষের আজো কামনা বন্ধ হোক যুদ্ধ, পৃথিবী হোক শান্তির নীড়।

তথ্যসূত্র
https://www.britannica.com/event/Holocaust
https://www.bbc.com/news/world-africa-26875506
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Anfal_genocide
https://www.bbc.com/news/world-asia-pacific-10684399

– সংগৃহীত

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top