সাইফুল আজম – লিভিং ঈগল খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বাঙ্গালী বিমান অফিসার

সাইফুল আজম

লিভিং ঈগল খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বাঙ্গালী বিমান অফিসার

বাংলাদেশে যে সকল গুনিজনের হাত ধরে বহির্বিশ্বে খ্যাতি ও পরিচিত লাভ করেছে এবং বাংলাদেশ যে সাহসী ও মেধাবীদের উর্বর ভূমি তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের সম্পর্কে হয়তো আমরা কমই জানি। তাদের মধ্যেই একজন হলেন সাইফুল আজম। যিনি আকাশ পথে দুঃসাহসিক সব অভিযান পরিচালনা করে বিশ্বের বিখ্যাত সব সামরিক খেতাব লাভ করাসহ বাংলাদেশ কে তুলে ধরেছেন অনন্য উচ্চতায়। তিনি বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে যুদ্ধ করে বীরত্ব প্রকাশ করাসহ সেসব দেশের প্রথম সারির সামরিক খেতাব লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। একই সাথে শক্তিশালী সব প্রতি পক্ষের বিরুদ্ধে আকাশে গড়ে তুলেছিলেন মৃত্যুর মিছিল। চলুন এই বর্ণীল সাহসী যুদ্ধার সম্পর্কে জেনে আসা যাক।

সাইফুল আজম ১৯৪১ সালে পাবনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।  এরপর কোলকাতায় পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়। কিন্তু ১৮৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি তার পরিবার সহ বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তানে) ফিরে আসেন। এখানে তিনি মাধ্যমিকের পড়াশোনা শেষ করে ১৯৫৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে গমন করেন। তারপর ১৯৫৮ সালে তিনি পাকিস্তান এয়ার ফোর্স ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। সেখান থেকে পড়াশুনা শেষ করার পর তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন। সে বছরই তিনি জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে পদন্নোতি পান।  তারপর তাকে দুই বছরের জন্য মার্কিন বিমান ঘাটিতে পাঠানো হয় প্রশিক্ষন গ্রহণের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের এরিজোনার ‘লুক এয়ারফোর্স বেইস’ এ তিনি প্রশিক্ষন গ্রহণ করেন। এসময় তিনি প্রথমে “সেসনা টি-৩৭” এবং পরবর্তীতে “এফ ৮৬ স্যাবরজেট ” দিয়ে প্রশিক্ষন গ্রহণ করেন। এরমধ্যে “এফ-৮৬ স্যাবরজেট” ছিল তৎকালীন যুগে সবচাইতে বিধ্বংসী জঙ্গি বিমানের মধ্যে একটি। এই উচ্চ প্রশিক্ষন শেষে ১৯৬৩ সালে দেশে ফিরে আসেন এবং পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ঢাকাস্থ কেন্দ্রে যোগদান করেন।

তার কিছুদিন পর আবার তিনি  করাচিতে গমন করেন। এবার তিনি একজন প্রশিক্ষক হিসেবে মাশরুর বিমান ঘাটিতে যোগদান করেন। এসময় তার কাছেই প্রশিক্ষন গ্রহণ করেন বাংলাদেশের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান। অর্থাৎ সাইফুল আজম সরাসরি মতিউর রহমানের সামরিক শিক্ষক ছিলেন। সাইফুল আজম এই প্রশিক্ষক হিসেবে থাকা কালীন সময়েই ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে তিনি এই যুদ্ধে যোগদানের জন্য ছুটে যান। তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ১৭ নম্বর স্কোয়াড্রনের হয়ে যুদ্ধে যোগদান করেন। পাকিস্তানের সবচাইতে বিধ্বংসী জঙ্গি বিমান দেয়া হয় তার হাতে একই সাথে তাকে গ্রুপ লিডার করে তার সাথে আরও কয়েকটি বিমান দিয়ে জুনিয়র অফিসারদের দ্বারা একটি টিম করে দেয়া হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বুক চিতিয়ে তিনি ও তার দল পাকিস্তানের আকাশ সীমা রক্ষা করে চলতে থাকেন। ১৯ শে সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ সালে ভারতীয় বিমান বাহিনীর সাথে তাদের সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে আকাশেই ভারতীয় একটি বিমান কে এমন ভাবে আঘাত করতে সক্ষম হন যে সেটি মুহূর্তের মধ্যেই ভূপাতিত হয়ে যায়। ফলে সে বিমানের পাইলট কে বন্ধি করা হয় এবং বাকি বিমানগুলো যে গুলো পাকিস্তানের আকাশ সীমানায় ঢুকে গিয়েছিল সেগুলাকে ভারতীয় আকাশ সীমা পর্যন্ত দাওয়া করতে সক্ষম হয়। তার এই দুঃসাহসিক অভিযান পাকিস্তান শিবিরে একটি সাফল্য পালক হিসেবে যুক্ত হয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পাকিস্তান সরকার তার এই কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে পাকিস্তানের তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননা ‘সিতারা-ই-জুরাত’ এ ভূষিত করে।

১৯৬৭ সালে আরব-ইজরাঈল যুদ্ধ শুরু হলে আরবদের যৌথ জোটের আহ্ববানে পাকিস্তান সরকার কয়েকজন দক্ষ-সাহসী বিমান বাহিনীর অফিসার কে আরবদের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য প্রেরণ করেন। তাদের মধ্যে সাইফুল আজমও ছিলেন। আরব-ইজরাঈল এই যুদ্ধ মাত্র ৬ দিন স্থায়ী হয়েছিল। প্রথম দিকে ইজরায়েল টানা আক্রমন চালিয়ে যান আরব রাষ্ট্রগুলোর উপর। তবে ইজরায়েলর বিরুদ্ধে কেউ বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। আরবদের মধ্যে সামরিক দিক দিয়ে মোটামুটি শক্তিশালী ছিল মিশর সেই মিশর কেই ৫দিনের মধ্যে লণ্ডভণ্ড করে ফেলে এবং তাদের বেশ কিছু অঞ্চল ইজরায়েল দখল করে নেয়। এদিকে সাইফুল আজম জর্ডান বিমান বন্দরে দায়িত্ব পান। ইজরায়েল যখন মিশরের সকল যুদ্ধ বিমান ও আকাশ পথের সকল যুদ্ধ সরঞ্জাম ধ্বংস করে দিয়ে জর্ডানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। তখন জর্ডান বিমান বাহিনী কে রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল সাইফুল আজমের উপর। কেননা ইজরায়েল কে প্রতিরোধ করার মত সক্ষমতা জর্ডানের হাতে কোন কালেই ছিল না। ইজরায়েল যখন জার্ডানের দিকে আক্রমনের উদ্দেশ্য নিয়ে অগ্নিমূর্তি ধারন করে এগিয়ে আসতে শুরু করে তখন জর্ডানের মাফরুক বিমান ঘাটি হতে সাইফুল আজম চারটি জঙ্গি বিমানের একটি বহরের নেতৃত্ব দিয়ে প্রবল বেগে আকাশে উড়ে যায়। ইজরায়েল ভাবতেই পারেনি যে জর্ডানের পক্ষ থেকে কোন পাল্টা আক্রমণ আসতে পারে। তাদের সকল সঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে সাইফুল আজম আকাশেই আক্রমন করে একজন পাইলটসহ একটি ইজরায়েলী বিমান কে ভূপাতিত করে। আরেকটি বিমান আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাছাড়া দুইজন বিমান বাহিনীর সৈনিক মারাত্মকভাবে আহত হয়। জর্ডানের এই শক্তিশালী প্রতিরোধের মুখে ইজরায়েল সঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং সেদিনের মত যুদ্ধ শেষ হয়। সাইফুল আজমের এই সাহসী অভিজ্ঞতার কথা শুনে জর্ডানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সাথে সাথে বিমান ঘাটিতে এসে সাইফুল আজমের সাথে দেখা করেন। তার এই বীরত্বপূর্ণ কর্মের জন্য জর্ডান হতে তাকে “হুসাম-ই-ইস্তিকলাল” খেতাবে ভূষিত করা হয়।

এখানেই শেষ নয়। এর অল্পকিছু সময় পরই সাইফুল আজমের ডাক পড়ে ইরাক বিমান ঘাটিতে। সেখানে তিনি ছুটে যান এবং ইজরায়েলী বিমান বাহিনী কে মোকাবিলা করার জন্য বুক চিতিয়ে বিদুৎ গতিতে বিমান নিয়ে আকাশে ছুটে যান। আর সেখানে এক রেকর্ড গড়ে মাত্র ৭২ ঘন্টার মধ্যে ৩টি ইজরায়েলী যুদ্ধ বিমান কে ভূপাতিত করে নতুন রেকর্ড গড়েন। তার এই কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ইরাকী বিমান বাহিনী হতে “নাত-ই- সুজাহ” সামরিক খেতাবে ভূষিত করা হয়।

আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের পর সাইফুল আজম আবার পাকিস্তানে ফিরে আসেন এবং পাকিস্তান বিমান বাহিনী তে যোগদান করেন। পাকিস্তানে ফেরার পর ১৯৬৯ সালে ‘শেনিয়াং এফ-৬’ জঙ্গী বিমানের ফ্লাইট কমান্ডার হন আজম। এরপর পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ‘ফাইটার লিডারস স্কুল’ এর ফ্লাইট কমান্ডারের দায়িত্ব নেন তিনি। সেখানেই থাকা কালিন সময়ে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান আবার তার কাছ থেকে শিক্ষানবিশ হিসেবে প্রশিক্ষন গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বেই পাকিস্তান সরকার তার বিমান চালনার উপর নিষেধজ্ঞা আরোপ করে তাকে গ্রাউন্ডেট করে রাখেন। ৬মার্চের পূর্বেই তিনি তার পরিবার কে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। তা থেকেই অনুমান করা যায় যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সকল প্রস্তুতিই তার নিকট ছিল এবং তিনি বিমান বাহিনী হতে বিমান ছিন্তাইয়ের ও পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তা আর সফল হয়নি।  তার ছাত্র বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান বিমান ছিন্তাই করতে গিয়ে নিহত হলে। সাইফুল আজম কে গ্রেপ্তার করা হয় এবং এই ঘটনার সাথে তাকে অভিযুক্ত করে ২১ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। তাকে ফাসি দেয়ার জন্যও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে খ্যাতিমান বিমান অফিসার হওয়ার কারনে পাকিস্তান সরকার সে অবস্থান থেকে সরে আসেন।

স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৯৭৭ সালে তিনি বিমান বাহিনীর উং কমান্ডার হন এবং তাকে ঢাকা ঘাটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তাছাড়া তিনি বিমান বাহিনীতে ডিরেক্টর অব ফ্লাইট সেফটি ও ডিরেক্টর অব অপারেশনস এর দায়িত্বও পালন করেন । অবশেষে ১৯৭৯ সালে অবসর নেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে।আশির দশকে তিনি দু’বার সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া পরবর্তীতে তিনি বিএফডিসি’র পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে মার্কিন বিমান বাহিনী সমগ্র বিশ্বের বিমান বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ ও সাহসী বিমান সদস্যদের তালিকা করেন এবং তাদের কে “লিভিং ঈগল” হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই তালিকায় বিভিন্ন দেশ থেকে ২২ জনকে স্থান দেয়া হয়। সাইফুল আজম এই ২২ জনের মধ্যে নিজের স্থান করে নেন। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে একমাত্র “লিভিং ঈগল” হিসেবে খেতাব পান।

তথ্যসূত্র

  • https://www.google.com/amp/s/akramn.wordpress.com/2011/02/09/%25
  • https://frontlinebd.com/%E0%A6%B2%E0%A6
  • https://roar.media/bangla/main/bangladesh/saiful-azam-a-great-fighter-pilot-of-bangladesh
  • https://bn.m.wikipedia.org/wiki/E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6

লেখকঃ ফরিদ মোল্লা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top