বেণী রায়ঃ চলনবিলের ত্রাস সৃষ্টিকারী ডাকুর কাহিনী

বেণী রায়

চলনবিলের ত্রাস সৃষ্টিকারী ডাকুর কাহিনী

গঙ্গাপথের গঙ্গাধর, কোহিতের বেণী
ছাতকের বসন্ত রায়, পুংগলির ভবানী।

চলনবিলের জলরাশির উপর গোধূলির আলো পড়েছে। কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যা নামবে। সন্ধ্যা নামার আগেই যাত্রীবাহী নৌকাগুলোর মধ্যে এক অদ্ভুত ব্যতিব্যস্ততা শুরু হয়েছে। কিসের যেন তাড়াহুড়ো, রাত নামার আগেই গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। নিরব অথচ গা ছমছমে এমন এক সন্ধ্যা বেলায় বেশ কিছু যাত্রী নিয়ে চলনবিল পাড়ি দিচ্ছিল একটি নৌকা। হঠাৎ করে মা কালী রব তুলে নৌকাটির উপর হামলে পড়ে একদল লোক। কারো বুঝতে বাকি নেই কারা ওরা। যাত্রীদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে গা ঢাকা দিল সময়ের দুর্ধর্ষ ডাকু বেণী রায়। যে নিজের নামেই গড়ে তুলেছে ভ্রাম্যমাণ এক ডাকাত দল। চলনবিল অঞ্চলের ত্রাস সৃষ্টিকারী ডাকাত বেণী রায় আজো কিংবদন্তি হয়ে ছড়িয়ে আছে মানুষের মুখে মুখে।

বলছিলাম মুঘল ভারতের কথা। সম্রাট আকবর দিল্লিতে আসীন ছিলেন মুঘল সর্বেসর্বা হিসেবে। তখন বাংলাদেশে মুঘল কর্তৃত্ব ঠিকমতো কায়েম করতে পারেননি তিনি। যার ফলে নিচু এই অঞ্চলে বারবার বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়েছে বিদ্রোহীরা। আইনশৃংখলা পরিস্থিতিও ছিল না আশাব্যঞ্জক। এমন অস্থির সময়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের চলনবিলে ডাকাতদের অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মুঘল সম্রাট আকবরের সময়ে এমনই এক ত্রাস সৃষ্টিকারী ডাকু ছিল বেণী রায়৷ যাকে দমন করতে সেনাপতি মানসিংহ পর্যন্ত প্রেরিত হয়েছিলেন। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ থানার কোহিত গ্রামের বেণী রায়ের প্রথম জীবন এমন ছিল না। ব্যক্তিজীবনে সে ছিল একজন সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ। তার ডাকাত হওয়ার পেছনে এক ট্র‍্যাজেডি ছিল। একদা বেণী রায় ভাদ্র মাসে তার স্ত্রী শংকরীকে নিয়ে চলনবিল হয়ে তার গ্রাম কোহিতে ফিরছিলেন। হঠাৎ বিলে তুমুল ঢেউ শুরু হলে বেণী রায়কে বহনকারী নৌকা ডুবে যায়। বেণী রায় নিজে সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও তার স্ত্রী দূরে গিয়ে আছড়ে পড়ে। ঠিক সেই সময় চলনবিল পাড়ি দিচ্ছিল মুঘলদের একটি শাহী বজরা। বজরায় থাকা মুঘল সেনাপতি কাসেম খান শংকরীর অচেতন দেহ উদ্ধার করেন এবং সেবা শুশ্রুষার পর তার জ্ঞান ফিরে। সুন্দরী শংকরীকে কাসেম খানের পছন্দ হয় এবং তাকে বাঈজী বানিয়ে মুঘল হেরেমে প্রেরণ করে দেয়া হয়। এর প্রায় বছর তিনেক পর স্বামী বেণী রায় জানতে পারে তার স্ত্রী জীবিত আছে এবং সে এখন মুঘল হেরেমের বাঈজী৷ বেণী রায় তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে ব্যর্থ হোন। রাগে, ক্ষোভে আর অভিমানে বেণী রায় হয়ে উঠেন প্রচণ্ড মুসলিম বিদ্বেষী৷ নিজ গ্রাম কোহিতে প্রতিষ্ঠা করে যবন মর্দিনী কালীমূর্তি। প্রতি কালীপূজায় মুসলমান ধরে এনে এই মন্দিরে বলি দেয়ার সংকল্পে নিজেকে পরিণত করে ডাকাত হিসেবে। বেণী রায় কালীভক্ত হিসেবে ডাকাতি পেশা শুরু করে দেয়। তার দলে জুটে যায় বেশকিছু শিষ্যও। রাতদিন চলতে থাকে লুটপাট আর রাহাজানি। খুব অল্প সময়ে বেণী রায়ের ডাকু বাহিনী হয়ে উঠে চলনবিল অঞ্চলের মূর্তিমান আতংক। বেণী রায় প্রতিজ্ঞা করে কাসেম খানের পুত্র দিলীর খানকে যতক্ষণ না পর্যন্ত বলি দিবে ততোদিন তার শান্তি নাই৷ নাটোরে জন্ম নেয়া প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী বলেন, বেণী রায় যেসকল মুসলমানদের বলি দিতো তাদের কাটা মুন্ডু জমিয়ে রাখত এবং ধড় বিলে ফেলে দিত। বেণী রায়ের প্রতি এবার মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করে মুঘল বাহিনী৷ বারো ভূইয়াদের দমন, কুচবিহারের রাজার সাথে সন্ধি স্থাপন এবং বেণী রায়কে শাস্তি দিতে মুঘল সেনাপতি মানসিংহকে প্রেরণ করা হয়। বেণী রায় তখন সন্ন্যাসী সেজে দিলির খানকে বন্দী করার পায়তারা করছিল।  মানসিংহ যখন বারো ভূইয়াদের দমন করতে ব্যস্ত ছিলেন তখন তার ভাই ভানুসিংহ বেণী রায়ের সাথে সন্ধি করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং সে অনুযায়ী তাকে একটি প্রস্তাবও পাঠানো হয় ভানুসিংহের পক্ষ থেকে৷ প্রস্তাবটি ছিল এমন,

“এখন মুঘল সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়েছে। এরা হিন্দুদের প্রতি সম্পূর্ণ অনুকূল৷ তীর্থরাজ প্রয়াগে মুকুন্দরাম ব্রহ্মচারী তপস্যা করতেন। হঠাৎ তার মনে বিষয় বাসনা উদ্রেক হওয়ায় তিনি আত্নগ্লানিতে গঙ্গা যমুনা সঙ্গমে কামনাকুণ্ডে আত্মবিসর্জন করেছিলেন। তিনিই জন্মান্তরে সম্রাট আকবররূপে জন্মগ্রহণ করেছেন। তার সাম্রাজ্যে মুসলমানরা আর হিন্দুর উপর অত্যাচার করতে পারে না। বরঙ মুসলমান অপেক্ষা এখন হিন্দুদেরই প্রাধান্য। তাঁর সাথে আপনার শত্রুতা করা অনুচিত। “

বেণী রায়ের সকল আক্রোশ ছিল মুসলমানদের উপর। সম্রাট আকবর পূর্বজন্মে হিন্দু ছিলেন এই কথাটি মিথ্যে হলেও বেণী রায় এটিকে সত্যি বলে মনে করে এবং সন্ধি করতে রাজি হয়। সন্ধির শর্ত অনুযায়ী বেণী  রায়কে এক পরগণার জমিদারি ও ১২০০ বিঘা দেবোত্তর জমি দেয়া হয়। তখন থেকে বেণী রায় দস্যুপনা ছেড়ে ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করেন। তারপরেও বেণী রায়ের মনে প্রতিশোধস্পৃহা জিইয়ে থেকে যায়। ভুলতে পারেনি দিলীর খানকে বলি দেয়ার সংকল্প৷ বেণী রায় পুনরায় জেগে উঠে এবং দিলীর খানকে বন্দী করে। বেণী রায়ের এমন স্পর্ধায় ক্ষেপে যান মানসিংহ৷ দলবল নিয়ে পথ ধরেন বাংলার৷ মানসিংহের আগমনের খবর পেয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায় দুর্ধর্ষ ডাকু বেণী রায়। আজো বেণী রায়ের ভিটা পণ্ডিত ডাকাতের ভিটা বা শয়তানের ভিটা নামে পরিচিত।

তথ্যসূত্র

  1. চলনবিল-প্রমথনাথ বিশী
  2. চলনবিলের ইতিকথা -অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আবদুল হামিদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top