ভুলে যাওয়া ভারতের ঝোপের প্রাচীর – The Great Hedge of India

ভুলে যাওয়া ভারতের ঝোপের প্রাচীর
The Great Hedge of India

আমরা সবাই চীনের মহাপ্রাচীরের কথা শুনেছি এবং এই বিশাল প্রাচীরের ইতিহাস সবাই কমবেশী জানি। আজ আমরা একইরকম আরেকটি প্রাচীরের সম্পর্কে জানব। এটি “বিখ্যাত ঝোপের প্রাচীর” , যার অবস্থান ছিল এই ভারতেই। ইংরেজীতে একে  The Great Hedge of India বলা হয়।

বৃটিশ শাসনামলে ভারতের অভ্যন্তরীন শুল্ক আদায়ের জন্য এটি তৈরী করা হয়েছিল। এটি মূলত লবণ করের উদ্যেশ্যেই নির্মাণ করা হয়েছিল। বৃটিশ সরকারের লবণের ব্যাবসায়ীদের নিকট হতে কর আদায় নিশ্চিত করার জন্য এ ঝোপের প্রাচীর তৈরি করেছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক এ লবণ কর আদায় নিশ্চিত করার এ চেস্টা পরবর্তীতে বৃটিশ শাসনামল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

এ ঝোপের দৈর্ঘ্য কত ছিল? শুনলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। সময়ের পরিক্রমায় বৃটিশরা এ উপমহাদেশে নতুন নতুন জায়গা দখল করেছে এবং এ ঝোপ গাছ দিয়ে বানানো প্রাচীরকে বড় করেছে। প্রাকৃতিক বাধাসমূহের পাশ দিয়ে এবং মূলত নদীর কূল বা জনপদ থেকে জনপদে মানুষের প্রধান প্রধান চলার পথকে ভিত্তি করে এ প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল। ও হ্যা, এ প্রাচীরের দৈর্ঘ্য সম্পর্কে বলছিলাম, এ প্রাচীরের মোট দৈর্ঘ্য ছিল ২৫০৪ মাইল (৪০৩০ কিলোমিটার)। এটি পাঞ্জাব হতে শুরু করে দক্ষিণে উড়িষ্যায় বংগোপসাগরের উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এ লাইনটি শুরুতে মরা কাটাওয়ালা গাছের ডালপালা দিয়ে শুরু করা হলেও পরে এ লাইনটিতে জীবিত ঝোপ গাছ লাগানো হয়। পরে এ ঝোপগাছগুলো ১২ ফুট পর্যন্ত উচ্চতা হয়েছিল এবং কিছু কিছু অংশে এটি ১৪ ফুট পর্যন্ত চওড়া ছিল। তৎকালীন ভারতের অভ্যন্তরীন কাস্টমস ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক এ প্রাচীর বরাবর তাদের কাস্টমস অফিসার, জমাদার এবং অন্যান্য দাপ্তরিক লোক দিয়ে পেট্রোলিং করাতো, যাতে কেউ কর না দিয়ে লবণ পাচার করতে না পারে।

প্রেক্ষাপট

১৭৮০ সাল হতে ওয়ারেন হেস্টিংস, তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল অব ইন্ডিয়া বেংগল প্রেসিডেন্সির সকল লবণ প্রস্তুতকারীকে করের আওতায় কোম্পানীর অধীনে নিয়ে আসেন। তখন হতে ১৭৮৮ সালের মাথায় এ লবণ কর প্রতি মণে ৩০ পয়সা হতে ৩.২৫ রূপীতে নিয়ে আসেন। এটি কোম্পানীর আয়ে একটি বিশাল ভূমিকা রাখত। ১৭৮৪-৮৫ অর্থ বৎসরে এ করের আওতায় ৬২,৫৭,৪৭০ রুপী আয় হয়। বৃটিশ শাসনাধীন অন্যান্য এলাকাতেও তারা লবণে করারোপ করত, কিন্তু বেংগল প্রেসিডেন্সিতে এটি ছিল সর্বোচ্চ। তাদের শাসনাধীন অন্যান্য এলাকায় এ করের পরিমাণ ছিল এক তৃতীয়াংশ। এ প্রসংগে একটি তথ্য দেয়া প্রয়োজন। তখন একজন মানুষের সারা বছর লবণ বাবদ ব্যয় হতো মাত্র ২ রূপী।

উপমহাদেশে বৃটিশ শাসনামলে ৫৬৪ টি Princely States ছিল। এগুলোকে নেটিভ স্টেটসও বলা হতো। এ এলাকাগুলো বৃটিশদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে ছিল না বা বৃটিশরা সেগুলোকে নিজেদের শাসনাধীনেও আনেনি। তবে এদের অধিকাংশের উপর তাদের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল। এসব এলাকা হতে লবণ বৃটিশ শাসনাধীন এলাকায় ঢুকে পড়ত বা অনেকেই নিয়ে আসত। এগুলো হতে তারা কর পেত না বলে এদের উপর কিভাবে করারোপের নিয়ন্ত্রণ আনা যায়, সে জন্যেই বৃটিশরা বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন শেষে এ হেজ ওয়াল এর ধারণায় আসে।

১৮০৩ সালে বিভিন্ন সড়কে এবং নদী বন্দরের নিকটস্থ এলাকায় তখন কর সংগ্রহের জন্য কাস্টমস হাউজ স্থাপন করে। এগুলো হতে শুধু লবণই নয়, তামাক এবং অন্যান্য দ্রব্যের উপরেও করারোপ করা হয়। ১৮২৩ সালের দিকে গংগা এবং যমুনার তীর ঘেষে মীর্জাপুর হতে এলাহাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। জি এইচ স্মিথ যখন কমিশনার অব কাস্টমস হন, তখন এটি আরো বিস্তার (এলাহাবাদ হতে নেপাল অব্দি একটি সেকেন্ডারি লাইনও তৈরি হয়।) লাভ করে। স্মিথ তখন  তামাক এবং লৌহজাতীয় দ্রব্য করমূক্ত করে দেন। স্মিথের সময় কর সংগ্রহের জন্য স্থাপিত কাস্টমস হাউজসমুহ, কর জনীত বিভিন্ন রিফর্মকে ১৮৪৩ এ দাপ্তরিকভাবে ইনল্যান্ড কাস্টমস লাইন বলে অভিহিত করা হয়।

এ কাস্টমস লাইনে প্রথমে আগ্রা হতে দিল্লী পর্যন্ত এক মাইল পর পর কাস্টমস পোস্ট স্থাপনের মাধ্যমে শুরু হয়। এ পোস্টগুলোকে চৌকি বলা হতো। প্রতিটি চৌকি একজন জমাদারের অধীনে পরিচালিত হতো। ১৮৫৮ সালে কোম্পানী শাসনের অবসান ঘটলে বৃটিশ সরকার ১৮৬৯ সালে কাস্টমস লাইন এর পুর্ণ বিস্তৃতি ঘটান। এসময় এই হেজ ওয়ালের পূর্ণ বিস্তৃতি ( ৪০৩০ কিমি) ঘটে। ১৮৬৯ – ১৮৭০ অর্থ বৎসরে ১২.৫ মিলিয়ন রুপী শুধুমাত্র লবণ কর হতে আদায় করা হয় এবং ১ মিলিয়ন রুপী কর আদায় হয় চিনি হতে।

ঝোপের প্রাচীর (The Great Hedge Wall)

ধারণা করা হয় যে, ১৮৪০ সালের দিকে প্রথম এ Hedge Wall এর কাজ শুরু করা হয়। প্রথমে  কাঁটাওয়ালা গাছের ডাল, মরা ঝোপ দিয়ে এটির কাজ শুরু হয় এবং পরে ১৮৬৮ সালের দিকে এটি ১৮০ মাইল লম্বা হয়ে যায়। কিন্তু এতে তখন কিছু অসুবিধা দেখা দেয়। এসব ঝোপে ইদুর, উই এর ঢিপি হতে থাকে এবং এসবের পাশাপাশি আগুন লাগলে বা ঝড়ের সময় এ প্রাচীরটি মূহুর্তের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। ক্রমাগত রক্ষণাবেক্ষণ তখন একটি বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এলান অক্টাভিয়ান হিউম, যিনি ১৮৬৭ হতে ১৮৭০ পর্যন্ত অভ্যন্তরীন কর কমিশনার ছিলেন, হিসেব করে দেখেন যে, প্রতি মাইলে মোট ২৫০ টন শুকনো ঝোপ এবং ডালপালার প্রয়োজন পড়ে এবং সেগুলো গড়ে কোয়ার্টার মেইল হতে ৬ মেইল দূর হতে আনা হয়। এ অবস্থায় এর বিশাল রক্ষণাবেক্ষণের কথা ভেবে তখন এ প্রাচীরে জীবিত ঝোপ গাছ এনে লাগানোর প্রস্তাবনা করা হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ঝোপের প্রাচীরের জন্য প্রয়োজনীয় ডালপালাও এই জীবিত গাছগুলো হতে সংগ্রহ করা যাবে।

১৮৬৯ সালে হিউম তখন পরীক্ষামূলকভাবে এ জন্য বিভিন্ন স্থানের মাটির গুণাগুণ বিবেচনায় এনে এলাকাভেদে বৃষ্টির পরিমাণ, সেচের সুবিধার ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরণের ধরণের কাঁটাওয়ালা ঝোপ ঝাড়ের চারা এনে লাগানো শুরু করেন।  যে সকল জায়গায় সেচের সুবিধা সীমিত ছিল সেসব স্থানে এ প্রাচীর ঘেষে ট্রেঞ্চ খোড়া হয়, যাতে সেখানে বৃষ্টির পানি জমানো যায়।একই সাথে এ প্রাচীর বরাবর রাস্তা নির্মাণও করা হয়। এ রাস্তা ধরেই মূলত কর বিভাগের লোকজন পেট্রোলিং করত।

হিউম তার এ কাজে নিয়োগের সময়ে ৪৪৮.৭৫ মেইল দীর্ঘ প্রাচীর তৈরি করেন, এর মধ্যে ২৩৩.৫ মেইল ছিল নিখুঁত, যেগুলো দিয়ে কোন মানুষ বা প্রাণী পার হতে পারতোনা। এ প্রাচীরটি ৮ ফুট হতে ১২ ফুট পর্যন্ত উচ্চতা এবং ৪ ফুট হতে ১৪ ফুট পর্যন্ত চওড়া ছিল।

হিউম পরে অভ্যন্তরীন কাস্টমস বিভাগের বিভিন্ন এলাকার এ ধরণের প্রাচীরগুলো রিএলাইন করেন এবং বিভিন্ন এলাকার এ সেকশনগুলোকে সংযুক্ত করান।

হিউম এর পর জি এইচ এম ব্যাটেন ছয় বৎসর দায়িত্ব পালন করেন এবং তার সময়ে প্রথম বৎসরে পারফেক্ট হেজ ১১১.২৫ মাইল দীর্ঘ হয় এবং ১৮৭৩ সালে ভারতের দিল্লী এবং আগ্রা এলাকার দকে এ প্রাচীর দুর্ভেদ্য রূপ নেয়। ১৮৭৫-১৮৭৬ সালের দিকে এ প্রাচীরকে নতুন খনন করা আগ্রা ক্যানেল বরাবর রিএলাইন করা হয়।

জি এইচ এম ব্যাটেন এর পর ডব্লিউ এস হ্যালসি দায়িত্বভার গ্রহন করেন। তার সময়ে পারফেক্ট হেজ ৪১১.৫ মাইলে উন্নীত হয় এবং ভাল জীবিত গাছের হেজ আরো ১১০৯ মাইল দীর্ঘ হয়। যে সকল এলাকায় গাছ জন্মাতোনা সেসব এলাকায় শুকনো ঝোপ, এমনকি দেয়ালও স্থাপন করা হয়। এরপর ১৮৭৯ সালে এ প্রাচীরের সকল রক্ষণাবেক্ষণের কাজ স্থগিত করা হয়।

লোকবল

এ কাস্টমস চৌকিসমূহ এবং হেজ ওয়াল এর জন্য সেসময় একটি বড় জনগোষ্ঠির প্রয়োজন পড়ে। এসময় বিপূল সংখ্যক লোক নিয়োগ করা হয়। ১৮৬৯ সালে এর জনবল ছিল ১৩৬ জন অফিসার, ২৪৯৯ জন পেটি অফিসার এবং ১১,২৮৮ জন সাধারণ সদস্য। ১৮৭২ সালে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১৪,১৮৮ জন। তবে যখন এই বিশাল ঝোপের প্রাচীর পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়, তখন জনবল কমিয়ে ১০,০০০ জনে আনা হয়। এ বিশাল লোক নিয়োগের সময়েও বৃটিশরা তাদের ক্ষুরধার বুদ্ধির পরিচয় দেয়। এসময় তারা এ বিভাগে মোট জনবলের ৪২% ভাগ মুসলমান নিয়োগ দেয়। এদেরকে তাদের বসবাসের এলাকা হতে দূরবর্তি অঞ্চলে নিয়োগ দেয়া হয় এবং তাদের কাজের ধরণের জন্যে তাদেরকে সেসব অধিকাংশ অমুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় স্থানীয়দের সাথে অগ্রহনযোগ্য এবং অজনপ্রীয় করে তোলা হয়। সেটি প্রকারান্তরে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বিদের মধ্যে অনৈক্য বজায় রাখে। এতে শাসকগোষ্ঠিই লাভবান হয়। বৃটিশ শাসকগন এ হেজ ওয়ালের নিকটবর্তি বাসিন্দাদের নিকট হতে এ কাজে সহায়তা পাবার জন্যে জনপ্রতি ২ পাউন্ড বা ০.৯ কেজি লবণ করমুক্ত আনা নেয়ার সুযোগ দিতো। পাশাপাশি কাস্টমস বিভাগের চাকুরীটিও খুব লোভনীয় করা হয়েছিল। সাধারণ সদস্যদের তখন বেতন ছিল মাসে ৫ রূপী। একজন স্বচ্ছল কৃষকের মাসে আয় হতো ৩ রূপী।

১৮৬৮ সালে কাস্টমস সদস্যদের পরিবারসহ দায়িত্বের এলাকায় থাকার অনুমোদন দেয়া হয়। শুধু ১৮৬৯ সালেই এ বিভাগের লোকজন মোট ১৮ মিলিয়ন মাইল পেট্রোলিং করে। ২ মিলিয়ন কিউবিক ফিট মাটি কাটে এবং ১৫০,০০০ টন কাঁটা ঝোপ এবং ডালপালা হেজ ওয়ালের জন্য বহন করে। আবার ১৮৭৬-১৮৭৭ সালে ১১৫ জন দায়িত্বরত অবস্থায় মারা যায়, ২৭৬ জন বরখাস্ত হয়, ৩০ জন চাকুরী ছেড়ে পালায়, ৩৬০ জন ছুটিতে গিয়ে আর ফেরেনি এবং ২৩ জন অযোগ্য ঘোষিত হয়।

বিলুপ্তি

১৮৬৯ হতে ১৮৭২ পর্যন্ত দায়িত্বরত ভাইসরয় লর্ড মায়ো এ হেজ ওয়ালের বিলুপ্তির প্রথম পদক্ষেপ নেন। এরপর লর্ড নর্থব্রুক ১৮৭৬-১৮৭৮ এর দূর্ভিক্ষে করের হ্রাসের জন্য এ কাস্টমস লাইনের বিলুপ্তির জন্য জোরালো পদক্ষেপ নেন। এরপর বিভিন্ন কর পদ্ধতি রিফর্মের মাধ্যমে এবং অবশেষে সকল লবণ উৎপাদনকারীকে তাদের উৎপাদন এলাকাতেই কর প্রদানের ব্যাবস্থা ১৮৭৯ সালে এ বিশাল ঝোপের প্রাচীর (The Great Hedge Line) এর বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়।

সূত্রঃ Moxham, Roy.2001. Great Hedge of India Maps.London.Constable Publishers

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top