বিনয়, বাদল, দীনেশ ও সেই বিখ্যাত ‘Veranda Battle’

বিনয়, বাদল, দীনেশ ও সেই বিখ্যাত
Veranda Battle

ভারতবর্ষ তখনো ব্রিটিশ শাসনাধীন। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর যুদ্ধে স্বাধীনতার যে সুর্য্য ডুবে গিয়েছিল, যে বিদেশী বেনিয়া কুচক্রী বৃটিশরা সেদিন আমাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছিল, তারা ক্রমে ক্রমে গ্রাস করে নিয়েছিল এখনকার ভারত,পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং বার্মা দেশগুলোকে। ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে স্বাধীনতার দাবী ক্রমে ক্রমে দানা বেধে উঠছিলো বৃটিশ ভারতে। ১৮৮৫ সালের কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হল। ১৯১৫ সালে মহাত্মা গান্ধী দক্ষিন আফ্রিকা থেকে ফিরে কংগ্রেসে যোগ দিলেন। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির সাথে দ্বিমত পোষন করতেন নেতাজী সুভাষ বোস। তিনি বিশ্বাস করতেন শুধুমাত্র সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই পরাধীনতার শিকল ছিড়ে ফেলা সম্ভব। তারই প্রস্তুতি হিসেবে ১৯২৮ সালের কোলকাতার জাতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনে থেকে তিনি গোড়া পত্তন করলেন “বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স” এর। এর জিওসি ছিলেন সুভাষ বসু নিজে এবং সংগঠনের দায়িত্ব দেয়া হল মেজর সত্য গুপ্তকে। কংগ্রেস সভা শেষ হয়ে গেলে “বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স” কে আরও সংগঠিত করে গড়ে তুলতে সত্য গুপ্ত সারা বাংলায় ঘুরে বেড়ালেন এবং একটি শক্তিশালী দল হিসেবে গড়ে তুললেন। এই বেংগল ভলান্টিয়ার্সরাই সেদিন সশস্ত্র বিপ্লবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সে দিনের সে আন্দোলনে গোটা ভারতবর্ষকে নেতৃত্ব দিয়েছিল বাংলা।

ঢাকায় “বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স” এর কর্মকান্ডে যুক্ত হলেন অনেকেই, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র বিনয় কৃষ্ণ বসু। কিন্তু সেদিনের সে তরুন সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবে , স্বদেশী আন্দোলনে। সে সময়ে বাংলাদেশ প্রধান দুটি বিপ্লবী সঙ্গঠন ছিল “যুগান্তর” এবং “ অনুশীলন” দল। মেডিকেল স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থাতে বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের কাছে বিপ্লবের দীক্ষা নেন। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স ঢাকা শাখায় যোগ দেন বিনয়।

পুলিশের অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলার ইনস্পেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এফ জে লোম্যান এবং ঢাকার সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিশ ই হাডসনকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৩০ সাল, ২৯ আগস্ট সকাল, বাংলার ইনস্পেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এফ জে লোম্যান এবং ঢাকার সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিশ ই হাডসন তদানীন্তন ভারপ্রাপ্ত গভর্ণর হিউ স্টিফেনসনের স্ত্রী এলো মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল ও হাসপাতাল পরিদর্শন উপলক্ষ্যে তদারকির কাজে এলেন মিটফোর্ড হাসপাতালে। পুলিশের সতর্ক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই লোম্যানকে হত্যার উদ্দেশ্যে বিপ্লবীরা হাসপাতালে রোগী বেশে অবস্থান করছিলেন। বিপ্লবী দলের নেতৃত্বে ছিলেন বিনয় বসু। এফ জে লোম্যান পরিদর্শন শেষে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পরপরই বিনয় বসুর রিভলবারের গুলিতে গুরুতর আহত হলেন তিনি এবং হাডসন। পুলিস ঘিরে ফেলল এলাকা। কে খুন করল? কোথায় সে? একে একে সবাইকে জেরা করল পুলিস। যে ঝাড়ুদার হাসপাতালের মেঝে ঝাড়ু দিচ্ছিল তাকেও জেরা করা হল। কিন্তু মুহুর্তের মধ্যে ঝাড়ুদার বনে যাওয়া বিনয়কে চিনতে পারল না পুলিস। এদিকে কোলকাতা থেকে বিমান যোগে চিকিৎসকদল এসেও গুলিবিদ্ধ লোম্যানকে বাঁচাতে পারেনি। মনে করা হয় বুলেট শিরদাঁড়াকেও আঘাত করেছিল।

বিনয় বসু সুকৌশলে মুহূর্তের হাসপাতাল ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে চলে যান। লোম্যান হত্যাকারী বিপ্লবী বিনয় বসুকে উদ্দেশ্য করে সেদিন বাংলার অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁকে আর্শিবাদ করে বলেছিলেন, “ধন্যি ছেলে, দেখিয়ে গেছে আমরাও জবাব দিতে জানি”।

এই ঘটনার পর ঢাকায় সর্বত্র পুলিশের অমানুষিক অত্যাচার শুরু হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে বাংলার ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এফ জে লোম্যানকে হত্যা করার পর এক আততায়ীর নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঢাকা পুলিশের অকর্মণ্যতার পরিচায়ক। সুতারং অকর্মণ্যতার গ্লানি দূর করার জন্য আসামীর সন্ধান করতে পুলিশ হন্যে হয়ে ওঠে। যুবকদের ধরে থানায় আটক রেখে নির্যাতন চালায়। পুলিশের অন্যায় অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠে ঢাকাবাসী। পুলিশের ভয়ে অনেক স্কুল-কলেজের ছাত্ররা ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যায়।

লোম্যান হত্যাকারী আততায়ীকে পুলিশ ধরতে সক্ষম না হলেও আততায়ী যুবক সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছিল। বিনয় কৃষ্ণ বসু জন্মেছিলেন ১৯০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। ঢাকা জেলার মুন্সিগঞ্জ মহকুমার রোহিতভোগ গ্রামে। তাঁর বাবার নাম রেবতীমোহন বসু। তিনি ছিলেন একজন প্রকৌশলী। বিনয়ের বাবা পরিবার নিয়ে ঢাকাতে বসবাস করতেন। তাই বিনয় বসু ছোটবেলা থেকে ঢাকায় বড় হয়েছেন। সম্ভবতঃ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল (বর্তমানের স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) এ ভর্তি হন। এই সময় বিনয় বসু বিপ্লবী রাজনীতিতে যুক্ত হন। ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের সংস্পর্শে এসে বিপ্লববাদী যুগান্তর দলে যুক্ত হন তিনি। শৈশব থেকে বিনয় বসু ছিলেন প্রচন্ড জেদী ও সাহসী। বিপ্লববাদী দলে যুক্ত হওয়ার পর তিনি তাঁর অসীম সাহস ও দূরদর্শিতা দিয়ে ব্রিটিশ শাসকদের উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার শপথ নেন। তিনি বিপ্লবী দলে যুক্ত হওয়ার পর সহপাঠীদের অনেককেই বিপ্লবী দলে যুক্ত করেন। ১৯২৮ সালে তিনি ও তাঁর সহপাঠী সহযোদ্ধারা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর “বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স” এ যুক্ত হন। এই বিপ্লবী দলে যুক্ত হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই বিনয় বসু এই দলের ঢাকা শাখা গড়ে তোলেন।

পুলিশ সারা বাংলা তন্নতন্ন করে বিনয় বসুকে গ্রেফতার করার জন্য খুঁজে ফেরে। কলেজ ম্যাগাজিন হতে তার ছবি সংগ্রহ করে সর্বত্র বিনয় বসুর ছবিযুক্ত পোস্টার লাগান হয়। ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মোটা অংকের টাকা, পাঁচ হাজার মতান্তরে দশ হাজার, পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কোথাও বিনয় বসুকে পাওয়া গেল না।

আর অন্যদিকে বিনয় বসু ও দলীয় সদস্য সুপতি রায় মুসলিম শ্রমিক বেশে দোলাইগঞ্জ (গেণ্ডারিয়া) রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে চাষাড়া যান। চাষাড়া স্টেশনে ট্রেন থামা মাত্র তাঁরা দেখতে পেলেন, পুলিশ প্রতিটি কামরায় উঠে আততায়ীকে ধরার জন্য চিরুনী অভিযান চালাচ্ছে। বিনয় বসু ও সুপতি রায় খুব সতর্কভাবে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ট্রেন থেকে নেমে যান। তাঁরা দুজন স্থানীয় বিপ্লবী গিরিজা সেনের বাড়িতে আত্মগোপন করেন। পরদিন ভোরে তাঁরা খেয়া পার হয়ে বন্দরে যান (নারায়নগঞ্জ শহরের বিপরীত পাড়)। সেখান থেকে বৈদ্যনাথবাজার। তারপর মেঘনা পাড়ি দেওয়ার পালা। মেঘনা পাড়ি দেওয়ার জন্য মুসলমান শ্রমিকের বেশ পরিত্যাগ করে সুপতি রায় জমিদার এবং বিনয় বসু জমিদার ভৃত্যের ছদ্মবেশ ধারণ করেন । বিনয় বসু জমিদারের (সুপতি রায়) সফরের জন্য একখানা নৌকা জোগাড় করেন। শুরু হয় মেঘনা পাড়ি। নৌকা থেকে একসময় স্টীমারে উঠতে সক্ষম হন। স্টীমারে উঠে আবার মুসলমান শ্রমিকের বেশ ধরেন। তারপর স্টীমারে চড়ে ভৈরব স্টেশন, সেখান থেকে ট্রেনে চড়ে কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিশোরগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন থামলে পুলিশ আততায়ী ধরার জন্য ট্রেনে উঠে গাড়ীর কামরাগুলো একে একে তল্লাশি চালানো শুরু করলে তাঁরা কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। হঠাৎ জানালার পাশে টিটিকে দেখে দুজনে তড়িঘড়ি গাড়ি থেকে নেমে টিটির কাছে টিকিট না করে ট্রেনের চাপার জন্যে ক্ষমা চান। দুজনই টিটির সাথে টিকেট ঘরের দিকে টিকিট কাটতে চলে যান। ইতিমধ্যে ট্রেনের সকল কামরা তল্লাশি করা শেষ হয়ে যায়। ভীত যাত্রীর অভিনয়ে কোন রকমে পার পান সে যাত্রা। দুজনে গিয়ে ট্রেনে ওঠেন। ট্র্রেন চলে ময়মনসিংহ স্টেশনের পথে।

ময়মনসিংহ স্টেশনে আবার এক বিপদ। ট্র্রেন থামার সাথে সাথে এক দারোগা তাঁদের বগিতে উঠে তল্লাশি শুরু করে। বিনয় বসু ও সুপতি রায় ততক্ষণাৎ পুলিশকে ফাঁকি দেয়ার পরামর্শ সেরে নেন। বিনয় বসু ছেঁড়া কাপড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলেন আর সুপতি রায় দু-হাত জোড় করে দারোগাকে তার ভাতিজা অসুস্থ বলে জানান, ‘মনে হয় বসন্ত হইছে’ বলায় বসন্তরোগভীত দারোগা পরবর্তী স্টেশনে কাপড় মুড়ি দেয়া বিনয়ের মুখ না দেখেই সদলবলে নেমে যায়।

সেখান থেকে তাঁরা নিরাপদে জগন্নাথগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ হয়ে থেকে সোজা কোলকাতা দমদম স্টেশনে নেমে ওয়ালীউল্লাহ লেনে অবস্থিত বিপ্লবী সুরেশ মজুমদারের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। সুরেশ বাবুর বাড়ি ছিল বিপ্লবীদের অন্যতম নিরাপদ আশ্রয়স্থল।

ঢাকা থেকে বহু বিপদ-আপদের পথ পাড়ি দিয়ে বিনয় বসু কোলকাতা পৌঁছলেও নেতৃবৃন্দ নিশ্চিন্ত বোধ করেননি। তাঁরা বিনয়কে সর্বোচ্চ নিরাপদ স্থানে রাখার জন্য ‘কাতারামগড়’ কোলিয়ারীতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। অন্যদিকে কোলকাতা পুলিশ সবগুলো রেলস্টেশনে বিনয়কে ধরবার জন্যে বিশেষ সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিল। ব্যান্ডেল স্টেশনে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী বন্দুক হাতে প্রস্তুত। দুই-তিন মিনিটের মধ্যেই কোলকাতাগামী ট্রেন এসে পৌঁছাবে। তাঁদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সবগুলো কামরা বিশেষভাবে তল্লাশি করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। কারণ এই গাড়ীতেই বিনয় বসুর থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। ট্রেন এসেছে এমন সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মোটর গাড়ি দেখে পুলিশ বিস্মিত হল। তারা দেখল মোটর গাড়ি হতে নামলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কনফিডেন্টসিয়াল ক্লার্ক সরোজ রায় এবং তাঁর সঙ্গে দুজন আত্মীয়। আত্মীয় দুজনকে ট্রেনের কামরায় তুলে দিয়ে হাসি মুখে পুলিশকে “চারদিকে নজর রেখো” বলে সাবধান করে সরোজ বাবু গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। সরোজ বাবুর আত্মীয় দুজনের একজন ছিলেন বিনয় বসু।

বিনয় বসু কাতারামগড় কোলিয়ারীতে অনাথ দাশগুপ্তের বাড়ী চলে গেলেন। এই বাড়ি ছিলো বিপ্লবীদের আর একটি গোপন আস্তানা। সেখান থেকে তিনি কিছুদিন পর ফিরে এলেন কোলকাতায়। নেতারা চিন্তিত হয়ে পড়লেন বিনয়ের নিরাপত্তার জন্যে। বিপ্লবীরা নেতৃবৃন্দের কাছে এব্যাপারে পরামর্শ চাইলে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, লেডী অবলা বসু, শরৎ বসু, সুভাষ বসু, শরৎ চাটার্জিসহ প্রায় সকল নেতাই আত্মরক্ষার জন্য বিনয় বসুকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার উপদেশ দেন। সেই মত তাঁকে বিদেশ পাঠানোর জন্য কিংস-বর্জ ডকের জনৈক পদস্থ কর্মচারীকেও ঠিক করা হল। পরদিন তাঁকে সমুদ্রগামী একখানা জাহাজে তুলে দেওয়া হবে। যাতে করে তিনি সোজা ইটালীতে যেতে পারেন। কিন্তু সকল পরামর্শ ও প্রস্তুতির অবসান ঘটালেন বিনয় নিজেই, কিছুতেই মাতৃভূমি ছেড়ে যাবেন না তিনি, জানিয়ে দিলেন নেতাদের। পরবর্তী অভিযানে অংশ গ্রহণের দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করলেন।

ওই বছর ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার-নির্যাতন শতগুণে বেড়ে যায়। শত শত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বিপ্লবীদের গ্রেফতার করে জেলে আটক রেখে চলে নির্যাতন। এই সময় ব্রিটিশ পুলিশ সুভাষচন্দ্র বসু, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এবং সত্য বক্সীর মতো নেতৃত্বকেও গ্রেফতার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আটকে রাখে। একের পর এক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করায় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে নতুন বন্দীদের জায়গা দেওয়া যাচ্ছিল না। জেলের মধ্যে সৃষ্টি হলো এক অসহনীয় অবস্থা। রাজবন্দীদের মধ্যে বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠছিল। তাঁরা জেলকোড অনুযায়ী কয়েকটি দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন দমানোর জন্য ব্রিটিশ পুলিশ বেদমভাবে লাঠি চালায়। চলে নির্মম-নিষ্ঠুর অত্যাচার। সুভাস বসু, যতীন্দ্রমোহন এবং সত্য বক্সীরাও বাদ গেলেন না এই অত্যাচার থেকে। এ ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ল জেলের ভিতরে। জানা গেল এই অত্যাচারের পিছনে রয়েছে ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এনএস সিম্পসন। বিপ্লবীদের টার্গেট হলো কারা বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল লে. কর্নেল সিম্পসন। যিনি বসতেন ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ এ। বন্দীদের উপর পাশবিক নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত ছিল সিম্পসন। তাই সিম্পসনের নাম হত্যা তালিকার শীর্ষে ছিল।

তাই বিপ্লবীদের পরবর্তী অভিযান ছিল কোলকাতার ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণ। অসংখ্য পুলিশ প্রহরী পরিবেষ্টিত দুর্ভেদ্য অফিস ‘রাইটার্স বিল্ডিং’। এই ভবন আক্রমণ করে সেখান থেকে ফেরার আশা কেউ করতে পারে না। বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলোচনা চলল কে এই আক্রমণ পরিচালনা করবেন? বিপ্লবী নেতারা অনেক ভেবেচিন্তে এই দুঃসাহসী অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন বিনয় বসুকে। তাঁর সঙ্গী হলেন আরো দুজন নির্ভীক যুবক। মুন্সিগঞ্জ মহকুমার যশোলঙের সতীশচন্দ্র গুপ্তের পুত্র দীনেশ গুপ্ত ও মুন্সিগঞ্জ মহকুমার পূর্ব শিমুলিয়ার অবনী গুপ্তের পুত্র সন্তান বাদল গুপ্ত।

১৯১১ সালের ৬ই ডিসেম্বর তদানীন্তন ঢাকা জেলার যশোলঙে জন্মগ্রহণ করেন বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত। দীনেশের ডাক নাম ছিল – নসু। পিতা নাম ছিল সতীশচন্দ্র গুপ্ত এবং মাতার নাম ছিল বিনোদিনী দেবী। চার ভাই এবং চার বোনের মধ্যে দীনেশ ছিলেন পিতামাতার তৃতীয় সন্তান। সতীশচন্দ্র ছিলেন ডাকবিভাগের কর্মচারী। চাকুরী সূত্রে তিনি কিছু কাল গৌরীপুরে ছিলেন। সেখানেই দীনেশের শিক্ষারম্ভ হয়। পরে যখন দীনেশের নয় বছর বয়স হয় তখন তিনি ভর্তি হন ‘ ঢাকা কলেজিয়েট ‘ স্কুলে। কিশোর বয়সে দীনেশ ‘ বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স ‘ এ যোগদেন। 1926 সালে ঢাকা বোর্ড থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি মেদিনীপুরে তাঁর বড়োদাদা যতীশচন্দ্রের কাছে বেড়াতে যান। এই সময় থেকেই মেদিনীপুর শহরে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার সুপ্ত বাসনা তার মধ্যে জাগে। তবে দলের নির্দেশে সেবার তাঁকে ঢাকায় চলে আসতে হয়েছিল বলে তিনি মেদিনীপুরে বিশেষ কিছুই করতে পারেননি। 1928 সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে আই.এস.সি পরীক্ষা দেন। কিন্তু সেই পরীক্ষায় দীনেশ অকৃতকার্য হন। এরপর তিনি মেদিনীপুর গিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। এই সময় মেদিনীপুরে বিভিন্ন শাখা স্থাপনের দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় 1928 সালে দীনেশ ‘ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে’র কলকাতা সেশনের প্রাক্কালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস সংগঠিত ‘ বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স ‘ এ যোগদান করেন।

আর  বাদল গুপ্ত ১৯১২ সালে ঢাকার বিক্রমপুর এলাকার পূর্ব শিমুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাদল গুপ্ত। তাঁর আসল নাম ছিল সুধীর গুপ্ত, তবে সকলে তাঁকে বাদল বলেই ডাকতো। বাদলের পিতার নাম ছিল অবনী গুপ্ত। বাদলের পড়াশোনা শুরু হয়েছিল পিতা মাতার হাত ধরেই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর বাদল ভর্তি হয় ‘ বানারিপাড়া স্কুলে ‘। ছোটো বেলা থেকেই বাদল ছিল প্রচন্ড রাগী। তবে একটু বড় হওয়ার পর তার সেই মানসিকতা পাল্টায়। স্কুলে পড়ার সময় বাদল বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিকুঞ্জ সেনের সংস্পর্শে আসে। তার সান্নিধ্য থেকেই বাদল গুপ্ত স্বদেশি রাজনীতি সঙ্গে জড়িয়ে পরে। নিকুঞ্জ সেন ছিলেন বিপ্লবী দলের সদস্য। এই শিক্ষকের হাত ধরেই খুব সম্ভবত নবম বা দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় বাদল গুপ্ত ‘ বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ ( বি.ভি) নামে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। অল্পদিনের মধ্যেই বাদল এই সংগঠনের একজন সক্রিয় সদস্য হিসাবে নিজেকে প্রকাশ করেন।

কিশোর বয়স থেকেই বিনয় বসু, দীনেশ গুপ্ত ও বাদল গুপ্ত পরস্পর পরিচিত ছিলেন। বিপ্লবী নেতারা স্থির করলেন ভারত সরকারের সরকারী অফিসের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী কেন্দ্রস্থল ‘রাইটার্স বিল্ডিং’আক্রমণ করে দেখাতে হবে যে বিপ্লবীরা সক্রিয় রয়েছেন। তাঁদের একজনকে জেলে বন্দী করলে দশজন অগ্রসর হয়।

১৯৩০ সালের ৯ই ডিসেম্বর। আগের দিন দুই বিপ্লবী বাদল এবং দীনেশ সরেজমিনে দেখে এসেছেন রাইটার্স বিল্ডিংয়ের আশপাশ। বিনয়ের পক্ষে সম্ভব ছিল না প্রকাশ্য দিবালোকে রাইটার্স বিল্ডিং এলাকায় যাওয়া। প্রফুল্ল দত্ত, সুপতি রায়, নিকুঞ্জ সেন এবং রসময় সুর সবাই মিলে ছবি একে বিপ্লবীদের বুঝিয়ে দিলেন রাইটার্স বিল্ডিংয়ের ভিতরটা। রসময় সুরকে সাথে নিয়ে ট্যাক্সি বদল করে ঠিক দুপুর বারোটায় রাইটার্স বিল্ডিং পৌছলেন তিন বিপ্লবী। তিনজনেই ইউরোপীয় পোষাক পরা সাহেব। পিওনের হাতে ধরিয়ে দিলেন নতুন ভিজিটিং কার্ড “ মিঃ বি,এন, দে” অনুমতি মিলল ভেতরে যাওয়ার। সাহেব সিম্পসন তখন টেবিলে ঝুকে পড়ে কাগজ দেখছেন। তিনজন ভিতরে ঢুকতেই মুখ তুলে চাইলেন সাহেব।“ফায়ার” চিৎকার করে উঠলেন বিনয়। গুলি চালালেন তারা। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন সিম্পসন। সাহেবের পি,এ টেবিলের নীচে লুকিয়ে বেচে গেলেন। তিনজনে বেরিয়ে এলেন সিম্পসনের ঘর থেকে। কিন্তু ততক্ষনে পাহারা রত পুলিস এগিয়ে আসছে বারান্দা দিয়ে। এগিয়ে আসছেন কুখ্যাত পুলিস কমিশনার চার্লস টেগার্ট। বৃটিশদের হাতে ধরা দেবেন না তারা এমন সংকল্প ছিল তাদের। যতক্ষন রিভলভারে গুলি ছিল তারা এই অসম যুদ্ধ করে গেলেন। সামনে যে বৃটিশকে পেলেন তাকেই গুলি করলেন তারা। তাদের গুলিতে আহত হলেন অপর দুইজন বৃটিশ সাহেব- নেলসন এবং টিয়ানম্যান। রাইটার্স বিল্ডিঙের করিডোরে শুরু হল যুদ্ধ, স্টেটসম্যান পত্রিকা এই যুদ্ধকে নাম দিয়েছিল “veranda battle” “বারান্দা যুদ্ধ”।

রাইটার্স বিল্ডিং থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব ছিল না তা ভাল ভাবেই জানতেন তিন বিপ্লবী। তারা জানতেন মৃত্যুকেই তারা বরন করতে যাচ্ছেন। ফুরিয়ে এসেছে গুলি। আশ্রয় নিলেন সচিবালয়ের খালি পাসপোর্ট ঘরে। সেখানে চেয়ারে বসেই সায়ানাইডের ক্যাপসুল খেলেন বাদল। আর নিজেদের রিভলভার দিয়ে নিজেদেরকে গুলি করে আত্মহত্যার চেস্টা করলেন বিনয় এবং দীনেশ। ১৪ ডিসেম্বর হাসপাতালে মারা যান বিনয়। হাসপাতালে অজ্ঞান অবস্থায় বিনয় উচ্চারন করেছিলেন দুর্বোধ্য শব্দ “লেফট রাইট লেফট।

দীনেশ বেচে ওঠেন। তাকে বিচার করে ফাঁসি দেয় ইংরেজ সরকার ১৯৩১ সালের ৭ই জুলাই । জেলখানা থেকে অনেকগুলো চিঠি লেখেন দীনেশ। সে চিঠিতে জেলে নেতাজী সুভাস বোসের পদধুলি নিতে পারার কারনে নিজেকে ভাগ্যবান হিসেবে বর্ননা করেন দীনেশ।

তাঁদের স্মৃতিকে শাশ্বতকাল স্মরণীয় করিবার জন্যই ডালহৌসী স্কোয়ারের নাম পরিবর্তন করিয়া ‘বিনয়-বাদল-দীনেশবাগ” (বি বা দী বাগ) রাখা হয়েছে ।

সূত্র
১। অগ্নিযুগের ইতিহাস: ব্রজেন্দ্রনাথ অর্জুন। প্রকাশক: মুক্তধারা। প্রকাশকাল; ডিসেম্বর ১৯৭৯।
২। স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা: সুধাংশু দাশগুপ্ত, ন্যাশনাল বুকস এজেন্সি কলকাতা।
৩। ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা: চিন্ময় চৌধুরী। দে’জ পাবলিকেশন, কলকাতা। প্রকাশকাল: জানুয়ারী ১৯৯৮।
৪। somewhereinblog.com
৫। উইকিপিডিয়া

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top