হালাকু খানের দুর্ধর্ষ সব অভিযানের আদ্যোপান্ত

হালাকু খানের দুর্ধর্ষ সব অভিযানের আদ্যোপান্ত

পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে যে সকল নেতা নিজেদের কাজের মাধ্যমে স্মরণীয় হয়ে আছেন তাদের মধ্যে মোঙ্গল নেতা হালাকু খান ছিলেন অন্যতম। তবে তিনি ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন ভিন্ন এক কারণে৷ তার হাতেই ধ্বংসকাব্য রচিত হয়েছিল সমকালীন পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ শহর বাগদাদের৷ দশ দিনের ব্যবধানে প্রায় ষোল লক্ষ মানুষ হত্যা করে নৃশংসভাবে বাগদাদে কায়েম করেছিলেন তিনি মোঙ্গল আধিপত্য। এর পূর্বে পারস্যের রাজনৈতিক দূর্বৃত্তের দল গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়কে একইভাবে দমন করে মোঙ্গলদের সামরিক সক্ষমতাকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য এক উচ্চতায়। শেষ জীবনে এসে অনুতপ্ত হয়ে বৌদ্ধ ধর্মও গ্রহণ করেছিলেন বাগদাদের এ কসাই। তার ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনই আজকের আলোচনা।

১২১৭ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নেয়া হালাকু খান ছিলেন মোঙ্গলদের জাতির পিতা চেংগিস খানের নাতি৷ তার বাবা তুলি খান ছিলেন চেংগিস খানে কনিষ্ঠ পুত্র৷ হালাকু খান যখন প্রাপ্তবয়স্ক তখন মোঙ্গল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন তার ভাই মেংগু খান। মেংগু খান সিংহাসনে আরোহন করলে সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে সামরিক অভিযান পরিচালনা করার পরিকল্পনা হাতে নেন৷ আর এ কাজে তিনি তার ভাই হালাকু খানকে সবচেয়ে যোগ্য মনে করে তার উপর এ নতুন অভিযানের দায়িত্ব তুলে দেন। পারস্যে ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে উঠা রাজনৈতিক আততায়ীর দল এসাসিনন্স বা গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়কে দমন এবং বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফাদের সমুচিত শাস্তি দেয়াই ছিল এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য৷

গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হালাকু খানের যাত্রা

সেলজুক সুলতান মালিক শাহের সময়ে হাসান বিন সাবাহ যিনি কিনা পরিচিত ছিলেন পর্বতের বৃদ্ধ ব্যক্তি, তার হাত ধরেই এ উগ্রপন্থী আততায়ী দলের উত্থান ঘটে। এরা ছিল ইসমাইলীয় শিয়া সম্প্রদায় মতাবলম্বী। এরা সুন্নি মুসলিমদের উপর বীতশ্রদ্ধ থাকত৷ দলীয় স্বার্থের জন্য শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এ বাহিনীর সদস্যরা গুপ্তহত্যার আশ্রয় নিত৷ এ কাজে তারা ছিল সুপ্রশিক্ষিত৷ মূলত রাজনৈতিক নেতৃস্থানীয় লোকই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। আব্বাসীয় খিলাফতের দুর্বলতার সুযোগে এ সম্প্রদায় পারস্যের পূর্বাঞ্চলে বেশ প্রভাব বিস্তার করে। ধীরে ধীরে তারা প্রতিবেশি মোঙ্গল সাম্রাজ্যেও হানা দিতে থাকে। এদের হুমকি হিসেবে গণ্য করে মেংগু খান সামরিক অভিযান পরিচালনার মনস্থির করেন। ১২৫৬ সালে হালাকু খান এক সুপ্রশিক্ষিত মোঙ্গল বাহিনী নিয়ে গুপ্তঘাতকদের সমূলে ধ্বংস করে দিতে অগ্রসর হোন। এদিকে সেলজুক রোমের প্রতিদ্বন্দ্বী দুই সুলতান ফার্সের আতাবেক সাদ এবং আইজুদ্দিন হালাকু খানের পক্ষে যোগ দেন। প্রথমেই হালাকু খান পারস্যে অবস্থিত গুপ্তঘাতকদের দুর্গসমূহকে আক্রমণ করেন। হালাকুর ধারাবাহিক আক্রমণে এসাসিন্সদের শক্তিশালী চল্লিশটি দুর্গের পতন ঘটে৷ ওদিকে নিজেদের দুর্গ ধ্বংস হতে দেখে গুপ্তঘাতকরা নিজেদের অবশিষ্ট দুই দুর্ভেদ্য দুর্গ আলামুত এবং লানবাসার রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে উঠে। কিন্তু তারা অচিরেই ব্যর্থ হয়৷ মোঙ্গল বাহিনীর নিকট তাদের অবশিষ্ট দুর্গও ভস্মীভূত হয়ে যায়। এ যুদ্ধে পারস্যের সাধারণ নরনারীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এসাসিন্সদের শেষ নেতা রুকুনুদ্দিন মারা গেলে এ বাহিনী চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়৷

বাগদাদ আক্রমণ

মোঙ্গলদের হাতে শিয়া মতাবলম্বী এ উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পতন ঘটলে সুন্নি মুসলিমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। কিন্তু খুব শীঘ্রই তারা বুঝতে পারে মোঙ্গলদের দৃষ্টি কোনদিকে। আব্বাসী খিলাফতের রাজধানী বাগদাদ নগরী তখন সমৃদ্ধির তুঙ্গে। জ্ঞান বিজ্ঞান, বিত্ত বৈভবে বাগদাদ তখন ছিল অপ্রতিরোধ্য এক নগর। আর সে কারণেই ইতিহাসের বর্বর জাতিসত্তা মোঙ্গলদের চোখ পড়ে এ নগরীর দিকে। গুপ্তঘাতকদের ধ্বংস করে হালাকু খান তখন বাগদাদ আক্রমণের ছক কষছেন। অজুহাত খুঁজতে লাগলেন অভিযানের জন্য। ছুতো পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি তাকে। বাগদাদে আব্বাসীয় খলিফা ছিলেন তখন মুসতাসিম বিল্লাহ। তিনি ছিলেন দুর্বল প্রকৃতির শাসক। ইতিপূর্বে গুপ্তঘাতকদের বিরুদ্ধে অভিযানে বাগদাদের খলিফার নিকট সাহায্য কামনা করেছিলেন হালাকু খান। কিন্তু মুসতাসিম বিল্লাহ তেমন আগ্রহ দেখাননি। এই ছুতোয় ১২৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে এক বিশাল বাহিনী নিয়ে বাগদাদ দখল করতে অগ্রসর হোন দুর্ধর্ষ মোঙ্গল নেতা হালাকু খান। এসেই তার বাহিনী পুরো বাগদাদ নগর চারদিক হতে ঘিরে ফেলে।
সন্ত্রস্ত মুসতাসিম তার আমির উমরাহ নিয়ে এক জরুরি বৈঠক আহ্বান করেন। বৈঠকে অনেকেই যুদ্ধ এড়িয়ে সমঝোতার দাবি উত্থাপন করেন৷ আর এ জন্য খলিফার একটি দল হালাকু খানের কাছে সমঝোতার প্রস্তাব পেশ করে। কিন্তু হালাকু খান সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে খলিফা বরাবর একটা চিঠি প্রদান করেন। চিঠিতে মুসতাসিম বিল্লাহকে কাপুরুষ আখ্যা দিয়ে মোঙ্গলদের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করা হয়। সাথেও এও বলা হয় সাম্রাজ্যের যাবতীয় ধনসম্পদ মোঙ্গল সমীপে  আত্মসমর্পণ করতে অথবা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে। অনন্যোপায় হয়ে খলিফা তার সেনাবাহিনী প্রস্তুত করেন। এদিকে মুসতাসিম বিল্লাহর উজির ইবনুল আলকেমি দূর্ভাগ্যজনকভাবে সৈন্য কমিয়ে ফেলার পরামর্শ দেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন মোঙ্গল বাহিনীর গুপ্তচর। ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১২৫৮ সালে সর্বপ্রথম বাগদাদে প্রবেশ করে হালাকু খানের বাহিনী৷ নির্বিচারে হত্যা চালাতে লাগল পিশাচরূপী একেকটা মোঙ্গল সৈন্য৷ অবস্থা বেগতিক দেখে মুসতাসিম বিল্লাহ রাজকোষের সব সম্পদ হালাকু বরাবর সমর্পণ করে দিলেও শেষ রক্ষা হয়নি। চলতে থাকে হত্যাযজ্ঞ। নারী-শিশুরাও বাদ যায়নি হালাকুর গোগ্রাস থেকে। হত্যার এ উৎসবে বাগদাদের রাস্তা রক্তিম আকার ধারণ করে। তিলে তিলে গড়া উঠা শহর চোখের নিমিষেই ধ্বংস হয়ে যেতে থাকল। স্থাপত্য,  লাইব্রেরি গুড়িয়ে দেয়া হল। খলিফা মুসতাসিম বিল্লাহকে বস্তাবন্দি করে ঘোড়ার নিচে পিষ্ট করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হল। শুধুমাত্র কিছু চাটুকার এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ নির্দয় এ আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছিল। ইবনে খালদুনের মতে, প্রায় ষোল লক্ষ মানুষ এ মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে নিজেদের প্রাণ হারায়। এই ধ্বংসলীলায় পৃথিবীর সভ্যতার এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়।

হালাকু খানের অন্যান্য অভিযান

নৃশংসতার মাধ্যমে বাগদাদ দখল করে হালাকু খান এবার পাড়ি জমান সিরিয়ায়। একে একে হামাদান, নিসিবন ও আলেপ্পো শহর তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এশিয়া মাইনরেও তিনি মোঙ্গলদের আধিপত্য কায়েম করতে সমর্থ হোন। এরপর মিসরের মামলুকদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে গেলে আকস্মিক মেংগু খানের অসুস্থতার খবর শুনে রাজধানী কারাকোরামে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি।

মৃত্যু

মৃত্যুর ঠিক আগে হালাকু খান অনুতপ্ত হয়েছিলেন বটে। তার অনুতপ্ত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের মাধ্যমে। তবে তিনি জন্ম থেকে নিজেকে একজন নেস্টেরিয়ান খ্রিস্টান হিসেবে দাবি করেছিলেন। ১২৬৫ সালে দুর্ধর্ষ এ মোঙ্গল নেতা মৃত্যুবরণ করেন।

তথ্যসূত্র

  • মধ্যযুগের মুসলিম ইতিহাস-আশরাফউদ্দিন আহমেদ
  • উইকিপিডিয়া

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top