প্রাচীন চীনের ভূগর্ভস্থ বিস্ময় : টেরাকোটা সেনাবাহিনী

১৯৭৪ সালের এক গ্রীষ্মকালে উত্তর পশ্চিম চীনের শানশি প্রদেশের একদল কৃষক কুয়া খনন করতে গিয়ে কিছু মাটির তৈরি মূর্তির সন্ধান পায়। আর এই মূর্তিগুলোর সূত্র ধরে উৎসুক প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই স্থানেই খনন চালিয়ে আবিষ্কার করেন প্রায় দুই হাজার বছর পুরনো কিছু পোড়ামাটির মূর্তি যা পরবর্তী খননকাজের মাধ্যমে ধরা দেয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্বের অন্যতম বিস্ময় প্রাচীন চীনের টেরাকোটা সেনাবাহিনী । সুসজ্জিত এই পোড়ামাটির সৈন্যদলের হাল হকিকত জানতে মাঠে নামেন প্রখ্যাত সব প্রত্নতত্ববিদ। বেরিয়ে আসে চমকপ্রদ সব তথ্য।

২৪১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ১৩ বছর বয়সে চীনের ক্বিন রাজবংশের সম্রাট হোন শি হুয়াংদি। চীনের ইতিহাসে এই সম্রাট বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তার হাত ধরেই পত্তন হয় অবিভক্ত চীনের। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজবংশের সাথে ধারাবাহিকভাবে বিজয়ী সম্রাটের হাতে গড়ে উঠে ক্বিন রাজবংশ৷ ক্ষুদ্র সময় রাজ করা এই শাসকের সময় বেশকিছু কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। চীনের প্রথম এই সম্রাটের সময়ে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। নতুন হস্তলিপির প্রচলন, কৃষিকাজের সুবিধার জন্য খাল খনন, পরিমাপের পদ্ধতি আবিষ্কার এবং ধাতুর ব্যবহারের পদ্ধতি উদ্ভাবন হয় তার শাসনামলে। এছাড়া তার শাসনেই চীনের মহাপ্রাচীর তৈরির হয়। যোদ্ধা সম্রাট তার জীবনের প্রায় পুরোটা সময় কাটান যুদ্ধবিগ্রহ করে। পরাজিত গোত্রের পরিবারদের রাখার জন্য তিনি নিজ সাম্রাজ্যে গড়ে তুলেন প্রায় ২০০ প্রাসাদ। ক্রমাগত যুদ্ধের ভেতর যাওয়া সম্রাটের নিরাপত্তা নিয়ে তাই তিনি শংকিত থাকতেন। খুঁজছিলেন অমরত্ব লাভেরও উপায়। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হলে শি হুয়াংদি এক নজিরবিহীন কাজ করে বসেন। জীবদ্দশায়ই নিজের জন্য নির্মাণ করেন সমাধি। আর তার সমাধির নিরাপত্তার জন্য তৈরি করেন ৮ হাজার সৈন্যের পোড়ামাটির সেনাবাহিনী। সাথে ছিল রথ, ঘোড়ার বহর। প্রাচীন মিশরের মত চীনারাও বিশ্বাস করত মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অস্তিত্ব। তাই শত্রুর ভয়ে তটস্থ থাকা শি হুয়াংদি মনে করেছিলেন মৃত্যুর পরের জীবনে এই টেরাকোটার সেনাবাহিনী তাকে রক্ষা করবে।

টেরাকোটা আর্মিঃ সুসজ্জিত এক বিস্ময়

শি হুয়াংদির রাজধানী শিয়েনিয়েং এর অদূরে স্থাপিত এই সমাধির মূল স্তম্ভ এখনো অনাবিষ্কৃত থেকে গেছে। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালিয়ে সমাধিকে ঘিরে থাকা এর প্রথম ৩ খন্দ আবিষ্কার করা হয়েছে। প্রথম খন্দে স্থান পেয়েছে প্রায় ৬ হাজারের মত টেরাকোটা সৈন্য এবং রথের ঘোড়া। সর্বাগ্রে যুদ্ধংদেহী চেহারায় দাঁড়িয়ে থাকা জেনারেলদের পেছনেই রয়েছে মূল পদাতিক সেনাদল যাদের প্রত্যেকের হাতেই কোন না কোন অস্ত্র রয়েছে। হাজার হাজার এই মাটির সৈনিকদের কারোর চেহারার সাথে কারো মিল না থাকাটা এক বিস্ময়। কারো মুখভঙ্গি উন্মত্ত কারো বা স্বাভাবিক৷ যুদ্ধের ময়দানে থাকা একজন সৈনিকের মুখছবি যেভাবে ফুটিয়ে তুলা যায় ঠিক সেভাবেই ধারণ করা হয়েছে প্রতিটি মূর্তিতে। ২১০ মিটার লম্বা এবং ৬২ মিটার চওড়া এই খন্দে আছে ৩৮ টি ঘোড়ার রথ। সমাধিকে আবৃত করে রাখা দ্বিতীয় খন্দটি এই স্থানের তাৎপর্য বহন করে। ১৯৭৬ সালে এই খন্দ যখন খনন শুরু হয় তখন প্রত্নতাত্ত্বিকদের চোখ ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম হয়। চারটি সারিতে বিভক্ত এই বাহিনীর প্রথম ভাগে তীরন্দাজ বাহিনী, দ্বিতীয় ভাগে  যুদ্ধরথ, তৃতীয় ভাগে পদাতিক এবং চতুর্থ ভাগে অশ্বারোহী বাহিনীর বিন্যাস পরিলক্ষিত হয়। পুরো বাহিনীকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে  দেখলে মনে হবে আসলেই তারা বুঝি কোন যুদ্ধ ময়দানে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তৃতীয় খন্দটিতে সেনা জেনারেলদের কয়েকটি মূর্তি পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয় এই খন্দে যুদ্ধের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ দণ্ডায়মান ছিল। টেরাকোটা আর্মির সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার ছিল এর শারীরিক ভিন্নতা। সাজসজ্জা এবং পোশাক আশাক দেখে সৈন্যদের সামরিক পদমর্যাদা আঁচ করা যেত। কারো চুল খোঁপা করে ডানপাশে ফেলে রাখা হত আর কারো চুল পেঁচিয়ে খোপা করে রাখা হত। অশ্বারোহী বাহিনীর পোশাক ছিল নিয়মিত বাহিনীর থেকে আলাদা। গলায় স্কার্ফ, মাথায় পিলবক্স টুপি, বর্ম পরিধান করা যোদ্ধাদের ঘোড়ার পিঠে উঠার জন্য নরম জুতার ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়। প্রত্যেক সৈনিকের হাতে নিজ নিজ সামরিক র‍্যাংক অনুসারে অস্ত্রসস্ত্র শোভা পেত। এরকম হাজার  হাজার ব্রোঞ্জের অস্ত্র উদ্ধার করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। ক্রোমিয়ামের প্রলেপ থাকার কারণে এত বছর পরেও এই অস্ত্রগুলো অক্ষত  থাকাটাও আরেক বিস্ময়। তবে যেই সমাধিকে কেন্দ্র করে এতকিছু সেই সমাধি খনন করা এখনো সম্ভব হয়নি৷ পাছে সমাধি খনন করতে গিয়ে অন্য কোন মূল্যবান স্মারক ধ্বংস হয়ে যায় সেই ভয়ে আর খননকার্য এগিয়ে নেয়া হয়নি। তবে এর আশেপাশে এখনো খননকাজ  চলমান। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে নতুন করে আরো ২০০ টেরাকোটা আর্মি আবিষ্কৃত হয়েছে। ধারণা করা হয় সম্রাট শি হুয়াংদি তার সমাধির মেঝেতে পারদের প্রলেপ দিয়েছেন যাতে করে মনে হয় ভেতরে কোন বহমান নদী রয়েছে। সম্রাট শুধু নিজের মৃত্যু পরবর্তী জীবনের নিরাপত্তা বিধানেরই চেষ্টা করেননি সেই সাথে গায়ক, রক্ষিতাদেরও মূর্তি বানিয়ে রেখেছিলেন যাতে বিলাসীতারও যেন অভাব না হয়। ৩৬ বছর সময় নিয়ে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে সময় লেগেছিল ৭ লক্ষ শ্রমিক । সম্রাট বিশ্বাস করতেন তার মৃত্যুর পর এরা সবাই জেগে উঠবে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দিবে তাকে। মরণের পরে তিনি থাকবেন নিশ্চিন্তে, পরাক্রমশালী অবিভক্ত চীনের প্রথম সম্রাট শি হুয়াংদি।

তথ্যসূত্র
১. প্রথম রেফারেন্স
২. দ্বিতীয় রেফারেন্স
৩. তৃতীয় রেফারেন্স

লেখকঃ উবায়দুর রাজু

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top