পারস্য সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ ৬ আবিষ্কার

পারস্য সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ ৬ আবিষ্কার

বিশ্বসভ্যতাগুলোর মাঝে পারস্য সভ্যতা সবচেয়ে বেশি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মাধ্যমে এই পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করেছে। এজন্য এই সভ্যতাকে প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে বৈজ্ঞানিক সভ্যতা হিসেবে পরিচয় করা যায় এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের জন্য। রেফ্রিজারেটর, ব্যাটারি, সালফিউরিক এসিডের মত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার নিশ্চয়ই যুগের বিচারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। পারস্য সভ্যতার এমন কিছু আবিষ্কারের দিকেই চোখ ফেরানো যাক।

ইয়াকচাল (রেফ্রিজারেটর)

ইয়াকচাল নামের এই প্রাচীন রেফ্রিজারেটর পারস্যে প্রথম নির্মিত এবং ব্যবহৃত হয়। ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে পারস্যের বিজ্ঞানীরা এই পদ্ধতির পত্তন করেন। এই রেফ্রিজারেটরের আকার ছিল বিশালাকৃতির৷ উপর অংশ ছিল গম্বুজাকৃতি এবং নিচে ভূর্গভস্থ পানির মজুদ ছিল। ভূ-গর্ভস্থ এই অংশটি এক বছর পর পর পরিষ্কার করা হত। ৫ হাজার কিউবিক মিটারের আয়তন ছিল ভূ-গর্ভস্থ অংশের। এসব ইয়াকচাল শত শত বছর আগে নির্মাণ করা হলেও এখনো পর্যন্ত কিছু ধ্বংসাবশেষ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

ব্যাটারি

বিশ্বের প্রাচীনতম ব্যাটারি নির্মিত হয়েছিল পারস্যে৷ ইতিহাসে এই ব্যাটারি বাগদাদ ব্যাটারি নামেও পরিচিত।  একটি সিরামিক পট, ধাতব টিউব এবং অন্যান্য ধাতব পদার্থের নল দিয়ে তৈরি করা এই ব্যাটারির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার হয় আধুনিক ইরাকের মাহোজে এলাকায়। পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের হাতে যখন এই ব্যাটারি পৌছায় তখন এটা পরীক্ষা করে দেখা যায় এর জার সম্পূর্ণ ভিনেগার দিয়ে পরিপূর্ণ। বাগদাদ ব্যাটারি দেড় থেকে দুই ভল্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম ছিল। এই ব্যাটারি যদি পারস্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে তবে এটিই বিশ্বের প্রাচীনতম কোন ব্যবহারিক ব্যাটারি।

সালফিউরিক এসিড

পারস্য সভ্যতার আরেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার সালফিউরিক এসিড। পারস্যের বিখ্যাত বিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ এবং ভূগোলবিদ আবু বকর আল রাজী সর্বপ্রথম সালফিউরিক এসিড আবিষ্কার করেন। সে যুগে সালফিউরিক এসিডের আবিষ্কার তেমন গুরুত্ব বহন করেনি কিন্তু আধুনিক রসায়নের কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ভিত্তি গঠনে সালফিউরিক এসিড একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।  আধুনিক বিশ্বে কৃষি ও শিল্পখাতে সালফিউরিক এসিড বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ডাকব্যবস্থা

নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম নিয়মিত ডাকব্যবস্থার প্রচলন ঘটেছিল প্রাচীন পারস্যে। ঘোড়ায় চালিত ডাকের মাধ্যমে সরকারি নথিপত্র এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরের কাজে সর্বপ্রথম ডাকব্যবস্থার উত্থান হয়। গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরাডোটাস এর মতে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে একামেনিড সাম্রাজ্যের প্রথম রাজা সাইরাস দ্য গ্রেটের হাত ধরে পারস্য তথা পৃথিবী সর্বপ্রথম ডাক ব্যবস্থার সাথে পরিচিত হয়।  চাপার নামক এক বার্তাব্যবস্থা সেসময় প্রচলিত ছিল। এই ব্যবস্থায় বার্তাবাহক ঘোড়ার পিঠে বার্তা নিয়ে এক রিলে স্টেশন থেকে অন্য রিলে স্টেশনে দৌঁড়াতো। রিলে স্টেশনগুলো কাছাকাছি দূরত্বে স্থাপন করা হত যাতে করে ঘোড়া কোন খাদ্যগ্রহণ কিংবা বিশ্রাম গ্রহণ ছাড়াই বিরামহীন সেবা দিয়ে যেতে পারে। এই রিলে স্টেশনগুলোকে বলা হত চাপার কানেহ। এই চাপার কানেহ তে এসে বার্তাবাহক বার্তা নিয়ে আসত এবং অন্য বার্তাবাহকের কাছে বার্তা হস্তান্তর করত।

মানবাধিকারের ধারণা

আধুনিক বিশ্ব বর্তমানে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা আলোচনার টেবিলে খুব নিয়মিতই জায়গা করে নিচ্ছে এবং যেই বিষয়টি এই শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক ইস্যু সেই মানবাধিকারের ধারণার সর্বপ্রথম কাঠামোগত রূপ দিয়েছিল পার্সিয়ানরা। প্রাচীন পারস্যের সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেট ৫৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ যখন ব্যবিলন অধিকার করেন তখন সাইরাস সেখানকার দাসদের মুক্ত করার ব্যবস্থা করেন  এবং সেখানে তিনি বর্ণবাদ প্রথা রহিত করে প্রত্যেকের নিজ নিজ ধর্মীয় পালনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার এই ঘোষণা সুস্পষ্টভাবে কিউনিফর্ম লিপিতে আক্কাদীয় ভাষায় পোড়ামাটির ফলকে লেখা হয়। ইতিহাসে মানবাধিকারের এই নীতি পরিচিত সাইরাস সিলিন্ডার নামে। ১৮৭৯ সালে মানবাধিকারের নীতি সম্বলিত এই সাইরাস সিলিন্ডার আবিষ্কার হয়। বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এই ফলক যত্নের সাথে সংরক্ষিত আছে। সাইরাস দ্য গ্রেটের এই ঘোষণা জাতিসংঘের অফিশিয়াল ৬ টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়।

কর ব্যবস্থা

প্রাচীন পারস্যের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার কর ব্যবস্থার উত্থান। আক্কামেনিড সাম্রাজ্যের প্রশাসন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল কর ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থাকে বলা হত আক্কামেনিড কর ব্যবস্থা। সম্রাট দ্বিতীয় সাইরাস ও ক্যাম্বেসিসের আমলে আমলে প্রজারা উপঢৌকন প্রদান করে খাজনা প্রদান করত। নিয়মিত করব্যবস্থার প্রচলন ঘটে সম্রাট দাইরাসের আমলে। কিছু প্রাচীন নথিপত্র দ্বারা প্রমাণ পাওয়া সায় পার্সিয়ানরা কর হিসেবে গৃহপালিত পশু প্রদান করত। সাধারণ প্রজারা রাজকীয় কর থেকে মুক্ত হলেও তাদেরকে নিয়মিত কর প্রদান করে সাম্রাজ্যের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে হত।

লেখকঃ উবায়দুর রহমান রাজু

বি.দ্র : নিবন্ধটি আরেফিন লাইব্রেরি দ্বারা সংগৃহীত

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top