লালবাগ কেল্লা ও তার রহস্যে ঘেরা গুপ্তপথ

মোগল আমলে বাংলায় নির্মিত ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে ঢাকার বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত লালবাগের কেল্লা  ঢাকা শহরের প্রধান কয়েকটি দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম। সপ্তদশ শতকে নির্মিত একটি অসমাপ্ত মুঘল দুর্গ স্থাপনা এটি। লালবাগ কেল্লার নির্মাণের পূর্বের দিকের রক্তাক্ত ইতিহাস এ সাইটে আগেই বর্ণনা করা হয়েছে। মোঘল স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে আজো ঢাকার বুকে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে এ দূর্গটি। দূর্গের নানান দিকের সাথে সাথে দূর্গের অভ্যন্তরের রহস্যে ঘেরা গুপ্তপথ নিয়ে আজকের ফিচার।

লালবাগ কেল্লার নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৬৭৮ সালে, মুঘল সুবাদার মুহাম্মদ আজম শাহ কর্তৃক, যিনি ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র। পরবর্তীতে তিনি নিজেও সম্রাট পদপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তার উত্তরসুরী, মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ সালে নির্মাণকাজ পুনরায় শুরু করেন, কিন্তু শেষ করেননি।

দীর্ঘ সময় যাবত এটি ধারনা করা হতো যে, দুর্গটি হচ্ছে তিনটি ভবন স্থাপনার সমন্বয় (মসজিদ, পরী বিবির সমাধি ও দেওয়ান-ই-আম), সাথে রয়েছে দুটি বিশাল তোরণ ও আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত মজবুত দুর্গ প্রাচীর। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক খননকালের পর অন্যান্য অবকাঠামোর অস্তিত্ব প্রকাশ পেয়েছে ।

দক্ষিণের দুর্গ প্রাচীরে নির্দিষ্ট ব্যবধানে পাঁচটি বুরুজ ছিল, উচ্চতায় এগুলো দুই তলার সমান এবং পশ্চিমের দুর্গ প্রাচীরে ছিল দুটি বুরুজ যার সবচেয়ে বড়টি ছিল দক্ষিণস্থ প্রধান প্রবেশদ্বারের সামনে। বুরুজগুলোর পাশেই ছিল একটি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ। কেল্লাটির কেন্দ্রীয় এলাকা দখল করে ছিল তিনটি প্রধান ভবন। পূর্বে দেওয়ান-ই-আম ও হাম্মাম খানা, পশ্চিমে মসজিদটি এবং পরী বিবির সমাধি এক লাইনে অবস্থিত হলেও দূরত্ব কিন্তু সমান নয়। নির্দিষ্ট ব্যবধানে কয়েকটি ফোয়ারা সহ একটি পানির নালা তিনটি ভবনকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে ও উত্তর থেকে দক্ষিণে সংযুক্ত করেছে ।

সুবেদার আজম শাহ ১৬৭৮ সালে ঢাকায় একটি প্রাসাদ দুর্গ নির্মাণে হাত দেন। তখন ঢাকার সুবেদারদের থাকার জন্য স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা ছিল না। স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন করতে আসা সুবেদাররা ঢাকায় স্থায়ী ভবন নির্মাণে কোনো উৎসাহ দেখাননি। যুবরাজ আযম শাহ প্রথম এই উদ্যোগ নেন। তিনি অত্যন্ত জটিল একটি নকশা অনুসরণ করে দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু করেন। তিনি দুর্গের নামকরণ করেন কিল্লা আওরঙ্গবাদ। কিন্তু পরের বছর সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁকে দিল্লি ফেরত পাঠান। ফলে দুর্গের কাজ অসমাপ্ত রেখে তাঁকে দিল্লি চলে যেতে হয়।

এরপর সুবেদার হয়ে দ্বিতীয়বারের মত ঢাকা আসেন শায়েস্তা খাঁ। যুবরাজ আযম শাহ তাঁকে লালবাগ দুর্গের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য অনুরোধ করেন। শায়েস্তা খাঁ দুর্গের কাজ পুনরায় শুরু করেন, কিন্তু ১৬৮৪ সালে তাঁর অতি আদরের মেয়ে পরি বিবি অকস্মাৎ মারা গেলে তিনি অশুভ মনে করে এর নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন। এর পরিবর্তে নির্মাণ করেন পরিবিবির মাজার ‍বা পরিবিবির সমাধিসৌধ। এর মধ্যে লালবাগ দুর্গের প্রায় ১২ শতাংশ নির্মাণকাজ শেষ হয়ে যায়। দুর্গের নিয়ম অনুযায়ী একটি ভূগর্ভস্থ পথও নির্মাণ করা হয়। আত্মরক্ষা কিংবা প্রয়োজনবশত পালিয়ে যাওয়ার জন্য সাধারণত এ পথ ব্যবহৃত হয়। দুর্গের দক্ষিণ-পূর্ব দেয়ালের সঙ্গে যুক্ত আছে এ সুড়ঙ্গ পথটি।

রহস্যে ঘেরা গুপ্তপথঃ

লালব‍াগ কেল্লা’র নিচে রয়েছে অনেকগুলো সুড়ঙ্গ। এগুলো জমিদার আমলে তৈরি করা হয়। জমিদাররা বিপদের সময় এসব সুড়ঙ্গ পথে পালিয়ে যেতেন। তেমনই একটি সুড়ঙ্গ আছে এখানে, যার ভেতরে কেউ ঢুকলে তাকে আর ফিরে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ কেউ এই সুড়ঙ্গের ভেতর প্রবেশ করলে সে আর ফিরে আসে না। পরীক্ষা করার জন্য একবার দুটো কুকুরকে চেইনে বেঁধে সেই সুড়ঙ্গে নামানো হয়েছিলো। চেইন ফেরত আসলেও কিন্তু কুকুর দুটো ফিরে আসেনি। কথিত আছে, একবার এক উৎসুক যুবকও সুড়ঙ্গে প্রবেশ করেছিল কোমরে চেইন বেঁধে। বেশ কয়েক ঘণ্টা অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়া পরও যখন সে ফিরে আসেনি, তখন চেইনে টেনে উদ্ধার করা হয় শুধু কিছু হাড়গোড়। এ যেন হরর মুভিকেও ছাপিয়ে যাওয়া অলৌকিক কোনো কাহিনী!

স্থাপত্যবিদদের মতে, এ পথটি প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে টঙ্গী নদীর সঙ্গে যুক্ত। আবার কেউ মনে করে, এটি একটি জলাধারের মুখ। এর ভেতরে একটি বড় চৌবাচ্চা আছে। মোঘলদের পতনের পর লালবাগ দুর্গ যখন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়, তখন ঢাকাবাসীর সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এই সুড়ঙ্গ। আর তখন থেকেই নানা মুখরোচক কাহিনী চালু হয় সুড়ঙ্গটি নিয়ে।

যেহেতু সুড়ঙ্গ পথের রহস্য উদঘাটনের জন্য আজ পর্যন্ত প্রত্নতাত্তিক খনন কাজ হয়নি, তাই এটি নিয়ে নানা কল্পকাহিনী চালু আছে। এ কারণেই এ সুড়ঙ্গ পথটি ঢাকার আদি বাসিন্দাদের কাছে  এক বিরাট রহস্য। সাধারণ দর্শনার্থীদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় বা কৌতূহলবশত কেউ যেন এর ভেতরে প্রবেশ না করে, সেজন্য সুড়ঙ্গমুখে গেট নির্মাণ করে তাতে তালা লাগিয়ে দিয়েছে লালবাগ কেল্লা কর্তৃপক্ষ।

রেফারেন্স :
https://www.bd-pratidin.com/last-page/2018/04/26/325418
http://somoynews.tv/pages/details/174889/

লেখকঃ এস এম সজীব

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top