চেংগিস খানের ঘটনাবহুল জীবনের অজানা দিক

চেংগিস খানের ঘটনাবহুল জীবনের অজানা দিক

পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়ংকর এক শাসকের নাম চেংগিস খান। যার নাম শুনলে সমকালীন পৃথিবীর অপরাপর শাসকরা ভয়ে থরোথরো করত। ১১৬২ সালে উত্তর মঙ্গোলিয়ায় জন্ম নেয়া চেংগিস খান ছিলেন মোঙ্গল জাতিসত্তার পিতা৷ তার প্রতিষ্ঠিত মোঙ্গল সাম্রাজ্য পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চল দখলে রেখেছিল শত বছর। একজন নিষ্ঠুর শাসক হিসেবেই চেংগিস খানকে ইতিহাস মনে রেখেছে। শুধুমাত্র তার হাতেই পৃথিবীর ৪০ মিলিয়ন লোক নিহত হয়েছে। বিশ্বজয়ের স্বপ্নে বিভোর থাকা এই তাতার নেতার ঘটনাবহুল জীবনের এমন কিছু অংশের আলোচনা করব আজ যা হয়তো আপনার জানা নাও থাকতে পারে।

চেংগিস খান তার প্রকৃত নাম নয়!

মঙ্গোলিয়ার তৃণভূমিতে বেড়ে উঠা মোঙ্গল সাম্রাজ্যের মহান অধিপতি চেংগিস খানের প্রকৃত নাম ছিল তেমুজিন। মঙ্গোলিয়ার ভাষায় যার অর্থ লোহা৷ ১২০৬ সালের আগ পর্যন্ত তিনি এই নামেই পরিচিত ছিলেন। ১২০৬ সালে মোঙ্গলদের নেতা নির্বাচন করার ঐতিহাসিক আয়োজন কুরিলতাই সম্মেলনে তিনি নিজেকে ‘মহান খান’ উপাধিতে ভূষিত করে চেংগিস খান নাম ধারণ করেন। খান শব্দের অর্থ নেতা নির্দেশ করলেও ঐতিহাসিকরা এখনো পর্যন্ত তার চেংগিস নামের অর্থ খুঁজে পাননি। তবে ফলত চেংগিস খান দ্বারা পদাধিকারবলে সর্বোচ্চ কোন ব্যক্তিকেই বুঝানো হয়েছে।

চেংগিস খানের বাল্যকাল কেটেছে দস্যুবৃত্তি করে

চেংগিস খানের ছেলেবেলা সুখকর ছিল না। তার বয়স যখন নয় বছর তখন প্রতিপক্ষ গোত্র বিষ প্রয়োগে তার বাবাকে হত্যা করে। একই সাথে তার সাত ভাইবোনসহ মাকে নির্বাসন করে দেয়। এ সময় চেংগিস খান দস্যুবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েন। একদিন শিকার করতে খাবার নিয়ে বিরোধের জেরে চেংগিস তার সৎ ভাইকে হত্যা করে বসেন। কিশোর বয়সে তার স্ত্রী ও চেংগিস খান প্রতিপক্ষ গোত্র কর্তৃক অপহরিত হোন এবং সেখান থেকে পালানোর আগ পর্যন্ত  তেমুজিন দাস হিসেবে কাজ করেন।

চেংগিস খান চেহারা কেমন ছিল?

চেংগিস খানের জীবিত থাকার সময়ে তার কোন পোট্রের্ট অথবা ভাস্কর্যের সন্ধান পাওয়া যায়নি। যার কারণে তার চেহারা আসলে ঠিক কেমন ছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। অধিকাংশ সূত্র অনুযায়ী চেংগিস খান দেখতে লম্বা, তার বাবরি চুল এবং ঘন দাড়ি ছিল। চৌদ্দ শতকের পারস্যের কাহিনীকার রশিদ আল দ্বীন দাবি করেন, চেংগিস খান লাল চুল এবং সবুজ চোখের অধিকারী ছিলেন।

তার বিশ্বস্ত সব কমান্ডার ছিলেন তার পূর্ব শত্রু

চেংগিস খান একজন বিচক্ষণ যোদ্ধা ছিলেন। বর্ণ, গোত্রের তোয়াক্কা না করে মেধা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতেই তার বাহিনীতে সেনাদের মূল্যায়ন করতেন। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে যেসব মোঙ্গল কমান্ডার চেংগিস খানের বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছিলেন তারা পূর্বে তার ঘোরতর শত্রুও ছিলেন। ১২০১ সালে তাইজুত গোত্রের সাথে এক যুদ্ধে চেংগিস খানের ঘোড়া প্রতিপক্ষের তীরের আঘাতে আক্রান্ত হলে তিনি প্রায় মৃত্যুর মুখে পড়ে যান। যুদ্ধশেষে বন্দিদের উদ্দেশে চেংগিস খান যখন জানতে চান কে তাকে আক্রমণ করেছিল তখন আক্রমণকারী সৈন্য দাঁড়িয়ে উঠে বলে যে আমিই আপনাকে আক্রমণ করেছি। সৈন্যের এমন সাহসী উত্তরে অভিভূত চেংগিস খান ঐ মুহূর্তেই তাকে জেবে উপাধি দিয়ে নিজ বাহিনীর একজন করে নেন।

চেংগিস খানের হাতে নিহত হয়েছে পৃথিবীর ৪০ মিলিয়ন লোক!

ইতিহাসে চেংগিস খান একজন নিষ্ঠুর শাসক হিসেবেই পরিচিত। সাম্রাজ্য বিস্তারে যেকোন বাধা আসলেই তিনি তা নিষ্ঠুরতার সাথে দমন করতেন। আর এ কাজ করতে গিয়ে পৃথিবীর প্রায় ৪০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুবাণ ডেকে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। ইরানের খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যে যখন চেংগিস খান আঘাত হানেন তখন ইরানের মোট জনসংখ্যার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ লোক মোঙ্গল বাহিনীর হাতে নিহত হয়। চেংগিস খানের বর্বরতা এতোটাই ছিল যে, বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ১১ শতাংশ শুধুমাত্র তার আক্রমণেই পৃথিবীর মানচিত্র থেকে উবে গিয়েছিল।

চেংগিস খান পরধর্মে সহনশীল ছিলেন!

চেংগিস খানের অনেকগুলো বাজে গুণ ছাপিয়ে তার পরধর্মে সহনশীলতা তাকে এক অন্য মর্যাদায় নিয়ে গিয়েছিল। দখলীকৃত এলাকায় তিনি কখনোই নিজের ধর্মবিশ্বাস চাপিয়ে দেননি। বরং সবার ধর্ম পালনে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। এমনকি ধর্মীয় উপাসনালয় থেকে কর মওকুফ করে তিনি তার উদারতার পরিচয় দেন। যদিও তার এসব পদক্ষেপ যথেষ্ট রাজনৈতিক ছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্রজারা সুখে থাকলে তাদের পক্ষ থেকে বিদ্রোহ করার সম্ভাবনাও কম থাকে। চেংগিস খান ব্যক্তিগত ভাবে ছিলেন একজন সূর্যপূজারী। প্রায়ই তিনি সাম্রাজ্যের ভিন্ন ধর্মাবলম্বী নেতাদের নিয়ে উন্মুক্ত বিতর্কে অংশ নিতেন। শেষজীবনে এসে তাও নেতা কুই শুচির সাথে অমরত্ব ও দর্শন নিয়ে দীর্ঘ বিতর্কে অংশ নিতে প্রায়ই চেংগিস খানকে প্রত্যক্ষ করতে দেখা যেত।

চেংগিস খানের নাম মুছে দিতে চেয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন!

সারা বিশ্বে চেংগিস খান তুখোড় বিতর্কিত হলেও মঙ্গোলিয়ায় চেংগিস খান একজন জাতীয় বীর ও তাদের জাতির জনক বলে স্বীকৃত। বিংশ শতাব্দীতে মঙ্গোলিয়া যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের উপনিবেশে পরিণত হয় তখন পুরো মঙ্গোলিয়া জুড়ে চেংগিস খানের নামনিশানা মুছে দিতে অপারেশনে নামে সোভিয়েত সরকার। মঙ্গোলিয়ান জাতীয়তাবাদকে নিঃশেষ করে দিতে স্কুল কলেজের পাঠ্য থেকে চেংগিস খান সংক্রান্ত লেখা নিষিদ্ধ করা হয়, চেংগিস খানের জন্মস্থান খেনতি’তে তীর্থযাত্রা সব মঙ্গোলিয়ানদের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এমনকি সোভিয়েত শাসনে চেংগিস খানের নাম মুখে আনাও অপরাধ বলে গণ্য হত। নব্বই দশকে মঙ্গোলিয়া সোভিয়েত নাগপাশ থেকে মুক্ত হলে চেংগিস খান আবার মঙ্গোলিয়ার নাগরিকদের মানসপটে জায়গা করে নেন। রাজধানী উলানবাটোরের প্রধান বিমানবন্দরের তার নামে নামকরণ করা হয়। মঙ্গোলিয়ার মুদ্রায়ও শোভা পায় দ্য গ্রেট খানের ছবি।

History.com থেকে..

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top