জোহানেস গুটেনবার্গ
এক মহান বিজ্ঞানী যিনি প্রথম ধাতব মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করেন
আমার আপনার হাতে আজ যত বই আছে সব আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে চাইলেই খুব দ্রুতই একটি বই হাজার লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব। অথচ একটা সময় এমন একটি বইয়ের দ্বিতীয় আরেকটি কপির প্রয়োজন হলে খুজতে হতো কোন লেখক অথবা শিল্পীকে কিংবা কোন নকলবিসকে, যিনি পর্যাপ্ত সময় নিয়ে বইটির আরেকটি কপি তৈরি করে দিবেন। মানবজাতিকে ধীরগতির এ সমস্যার হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন ১৫ শতকের মধ্যভাগে জোহানেস গুটেনবার্গ। তার ছাপাখানা আবিষ্কার মুদ্রণ ব্যবস্থায় বিপ্লব নিয়ে আসে। আর এই বিপ্লব পৃথিবীতে রেনেসাঁর সূত্রপাত করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারন মূলত এখান থেকেই শুরু। মুদ্রণযন্ত্র সহজলভ্য হওয়ায় বই ছাপাও সুলভ এবং সহজ হয়ে ওঠে। আর তখন থেকে পৃথিবীর ইতিহাস আরো সহজে ছাপার অক্ষরে বইয়ের পাতায় স্থান পেতে শুরু করে। অথচ যার হাত ধরে এই ছাপাখানা আবিষ্কার, তার জন্মের ইতিহাসই সঠিকভাবে ছাপা হয়নি কোথাও।
জার্মানির মেইনজ শহরে জোহানেস গুটেনবার্গ ১৩৯৫ মতান্তরে ১৪০০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। যথাসময়ে স্কুলে ভর্তি হলেও পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারনে স্কুলের পড়াশোনা ছেড়ে স্বর্ণকারের দোকানে চাকরি নিতে হয় তাকে। কিশোর বয়সে আহরণ করা এ জ্ঞানই হয়তো পরবর্তীতে তাকে ধাতুর অক্ষর বানাতে সাহায্য করেছিলো।
ছোট শহরে কাজ শেখে আরেকটু ভালো কাজের জন্য মেইনজ শহর ছেড়ে স্ট্রেসবার্গ শহরে চলে আসেন গুটেনবার্গ। এখানে এসে স্বর্ণকারের দোকানে কাজ নিলেও এক বছর পর ১৪৩৫ সালে দোকানের স্বত্বাধিকারী এনড্রিয়াস ড্রিজেনের অংশীদার হিসেবে ব্যাবসার সাথে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। ব্যাবসা শুরু করার সময় ড্রিজেনের সাথে একটি চুক্তিনামা সই করেন। পাঁচ বছর মেয়াদী সেই চুক্তিতে বলা হয়, অংশীদারের মধ্যে কেউ যদি মারা যায়, তবে তার উত্তরাধীকারীদের ভেতর থেকে কাউকে অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করা হবেনা। উত্তরাধীকারী শুধুমাত্র ব্যাবসার লাভ্যাংশ পাবে। উত্তরাধীকারীর কেউ ব্যাবসার কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবেনা।
এ ঘটনার কিছুদিন পরেই গুটেনবার্গের পার্টনার ড্রিজেন মারা যায়। তার মৃত্যুর পর গুটেনবার্গ এই ব্যাবসাকে নিজের মত করেই পরিচালনা করছিলেন। ব্যাবসার লাভ্যাংশ পার্টনারের পরিবারের কাছে সময়মতো পাঠাচ্ছেন। এ সময় গুটেনবার্গ তার কারখানার এক কোনায় বিভিন্ন ধাতুর সংমিশ্রণ ঘটিয়ে টেকসই চলমান টাইপ মেশিন বানাতে চেষ্টা করছিলেন। অতি গোপনে গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে আবিষ্কারের পূর্বে কেউ কিছু না জানতে পারে। এসময় আবার তার পার্টনার ড্রিজেনের স্ত্রী এই ব্যাবসার টাকা গুটেনবার্গ অন্য খাতে ব্যয় করছেন বলে মামলা ঠুকে দেন তার বিরুদ্ধে। গুটেনবার্গ এ মামলায় হেরে যান। তার গবেষণার কথা আদালতকে জানাতে বাধ্য হয়। এ ঘটনা তার মনে খুব কষ্ট দেয়, তিনি স্ট্রেসবার্গ ছেড়ে দিয়ে মেইনজ শহরে ফিরে আসেন।
মেইনজ ফিরে এলে গুটেনবার্গের নতুন করে ব্যাবসা শুরু করার জন্য প্রয়োজন পড়ে অনেক টাকার। অংশীদার খুজতে থাকেন তিনি। এসময় জোহান ফাস্ট নামে এক ধনী ব্যাক্তি এগিয়ে আসেন গুটেনবার্গের ব্যাবসার অংশীদার হওয়ার জন্য। শর্ত হয় কিস্তিতে ফাস্ট মোট ষোলশো ডলার দেবেন গুটেনবার্গকে। সে অনুযা্যী ফাস্ট থেকে প্রাথমিক ৮০০ ডলার পেয়ে তা দিয়ে নানারকম ধাতু ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন গুটেনবার্গ। ১৪৫২ সালে ফাস্ট দ্বিতীয়বার আরো ৮০০ ডলার দেন গুটেনবার্গের হাতে। তখন গুটেনবার্গ রোমান ক্যাথলিক কিছু ধর্মীয় পুস্তক মুদ্রণ করে উপার্জন করতে থাকেন। তবে তখনো টাইপের মান নিঁখুত না হওয়ায় আরো গবেষণার প্রয়োজনবোধ করেন তিনি।
এদিকে ফাস্ট চাচ্ছেন তার টাকা। ছাপাখানা যেমনই চলুক, তার টাকা সময়মত ফেরত চান। অন্যদিকে শিল্পমনা গুটেনবার্গ তার টাইপ মেশিন আরেকটু উন্নত করার জন্য সময় চেয়েও পাচ্ছেন না জোহান ফাস্ট থেকে। ফাস্ট কিছু না শুনে টাকা ফেরত চেয়ে মামলা করে দেন গুটেনবার্গের বিরুদ্ধে। গুটেনবার্গ এ মামলায়ও হেরে যান। ফলে সুদ-আসল মিলিয়ে দু’হাজার ছাব্বিশ ডলার ফেরত দিতে বলা হয় জোহান ফাস্টকে। কিন্তু এতো টাকা তিনি তখন কোত্থেকে দেবেন! টাকার বিনিময়ে ছাপাখানার অংশীদারত্ব ছাড়তে বাধ্য হন তিনি।
অথচ গুটেনবার্গের গবেষণার ফলেই পৃথিবীর প্রথম চলনক্ষম ও ধাতু নির্মিত টেকসই টাইপ মেশিন আবিষ্কার সম্ভব হয়েছিলো। তার এই আবিষ্কারের ফলেই সম্ভব হয়েছে এক পান্ডুলিপিকে দ্রুত কম্পোজ করে মুদ্রণের পর্যায়ের নিয়ে যাওয়া। শুধু তাই নয়, বই ছাপা হয়ে যাওয়ার পর টাইপগুলোকে পৃথক করে পুণরায় কম্পোজের জন্য সাজিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছিলো এই আবিষ্কারের জন্যই। মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাসে গুটেনবার্গের এ পদ্ধতি এক স্বর্ণযুগের সূচনা করতে সম্ভব হয়েছে। গুটেনবার্গের ধাতব টাইপ ও মুদ্রণ পদ্ধতি উদ্ভাবনের আগে বই ছাপা হতো কাঠের টাইপের সাহায্যে। এসব টাইপ তৈরি করা হতো কাঠ খোদাই করে। আর তা ব্যাবহার করা যেতো শুধুমাত্র একবার।
গুটেনবার্গ যখন ফাস্টকে ছাপাখানাটি হস্তান্তর করেন ছাপাখানায় তখন ল্যাটিন ভাষায় একটি বাইবেল কম্পোজ হচ্ছিলো। সাথে ফুল লতাপাতার নক্সা সম্বলিত ধাতব ব্লকও ছিলো । এর সবকিছু সহ তুলে দিতে হয় ফাস্টের কাছে। এক জীবনে এর চেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা আর কি হতে পারে! পৃথিবীর সর্বপ্রথম গ্রন্থ ছাপাখানায় মুদ্রিত হচ্ছিলো।
গুটেনবার্গ এর কম্পোজ শুরু করা বাইবেলটি ১৪৫৬ সালের ১৫ আগষ্ট বাজারে বের হয়। বিশ্বের প্রথম মুদ্রিত বাইবেলটির সর্বমোট পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিলো ১২৮২। প্রতি পৃষ্ঠা সাজানো হয়েছিলো ২২ টি করে লাইন দিয়ে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়- মুদ্রাকর হিসেবে ছাপানো হয় জোহান ফাস্ট এর নাম। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি ছিলো এক জঘন্যতম প্রতারণা ও জালিয়তির কাজ। পরবর্তীতে অবশ্য এটি ‘গুটেনবার্গস বাইবেল’ নামে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু তাতেও গুটেনবার্গের জীবদ্দশায় তার আর ভাগ্য ফেরেনি। আমেরিকার ওয়াশিংটনের লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে গুটেনবার্গের ছাপা যে বাইবেলটি রয়েছে ১৯৬০ সালে তার মূল্য ধরা হয়েছে ৩,৫০০০০ মার্কিন ডলার। একেই বলে হয়তো ভাগ্য।
তখনকার নিঃস্ব গুটেনবার্গ জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়াতে থাকেন পথ থেকে পথে। এ সময় ডক্টর কনরার্ড হোমারি নামে এক ধনী ব্যক্তি গুটেনবার্গকে নতুন করে জীবন শুরু করার জন্য উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ততদিনে মন ও শরীর একেবারের ভেঙ্গে গিয়েছিলো তার। ষাটোর্ধ্ব বয়স নিয়ে আর ছাপাখানা গড়ে তুলতে পারেন নি গুটেনবার্গ। বাকি জীবন গির্জার একটি ছোট্ট ঘরে কাটিয়ে দেন তিনি। এভাবেই পরের মুখাপেক্ষী হয়ে ব্যাথিত হৃদয়ে ১৪৬৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
জীবদ্দশায় সম্মান পাননি তিনি। কিন্তু তাই বলে বিস্মৃতির অতলেও হারিয়ে যায়নি তার অবদান। আজ আমরা জানি, আপন প্রতিভাবলে বিজ্ঞানী গুটেনবার্গ কয়েকশো শতাব্দী এগিয়ে দিয়ে গেছেন এই পৃথিবীকে, এগিয়ে দিয়ে গেছেন এই মানব সভ্যতাকে। মানুষের মাঝে যতদিন সভ্যতার আলো থাকবে ততদিন মানুষ মনে রাখবে নিঃস্ব দরিদ্র এই মহান বিজ্ঞানীকে।