কামাল আতাতুর্ক : আধুনিক তুরস্কের জনক

কামাল আতাতুর্ক

আধুনিক তুরস্কের জনক

অটোমান খেলাফত যখন দুর্বল হয়ে পতনের দ্বারপ্রান্তে তখন ইউরোপ তাদের আধুনিক সভ্যতাকে সমগ্র বিশ্বের কাছে ছড়িয়ে দিতে ব্যস্ত। ঐ সময়ে যে ব্যাক্তিটি তুরস্ককে আধুনিক ভাবধারার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য দেবদূত হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি হলেন মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক। তিনি যখন দেখলেন তুর্কি সুলতানদের দুর্বলতার দরুন তুর্কি সাম্রাজ্যের পতন সুনিশ্চিত এবং পাশ্চাত্য ভাবধারার সাথে খাপ খাওয়াতে না পারলে তুর্কিবাসীর অর্থনৈতিক মুক্তি ও অগ্রযাত্রা সম্বব হবে না। ঐরকম এক মুহুর্তে তিনি তুরস্কের ক্ষমতায় আরোহন করে ভঙ্গুর তুর্কিকে ইউরোপীয় ভাবধারায় নতুন করে ঢেলে সাজান। এই কাজের ফলস্বরুপ তাকে আধুনিক তুরস্কের জনক হিসেবে অবহিত করা হয় এবং তাকে আতাতুর্ক বা তুর্কি জাতির পিতা হিসেবে উপাধি দেয়া হয়।

মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক আধুনিক গ্রীসের অন্যতম বৃহত্তম নগরী সালোনিকায় ১৮৮১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তখন এই নগরীটি আটোমান সাম্রাজ্যের অধিনে একটি শাসিত অঞ্চল হিসেবে ছিল। তার পিতার নাম ছিল আলী রিজা ও তার মাতার নাম ছিল জুবেদী। তার পিতা পেশায় ছিল শুল্ক বিভাগের একজন কেরানী। বাল্যকালে তার নাম ছিল মুস্তফা।

স্থানীয় মক্তবে তার শিক্ষা জীবনের সুত্রপাত হয়। অল্প কিছুদিন পর তার বাবা মারা গেলে তাদের পরিবারে ব্যাপক আকারে দুঃখ কষ্ট নেমে আসে। ফলে সে বাধ্য হয়ে সালোনিকা থেকে ১৮ মাইল দূরে এক গ্রামে তার ভাইয়ের সাথে এক খামারে আস্রয় গ্রহণ করেন এবং সেখানে থেকে তার পড়ালেখা চালানোর চেষ্টা করতে থাকেন। পরবর্তীতে তার মামা ও এক জৈনক সামরিক অফিসারের সহায়তায় তিনি সেলোনিকার সামরিক স্কুলে একজন ক্যাডেট হিসেবে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। সেখানেই তার জ্ঞানের গভীরতা প্রকাশ পেতে থাকে এবং অল্প দিনের মধ্যেই তিনি গনিত ও ফারসি ভাষায় তার দক্ষতা দেখিয়ে একজন ভাল ছাত্র হিসেবে নিজেকে প্রমান করতে সক্ষম হয়। তারপর তিনি জার্মান ভাষা শিক্ষা করেন। ১৮৯৯ সালে তিনি তার মেধার প্রমাণ দিয়ে সদ্য কমিশন প্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট হিসেবে হারবী সামরিক কলেজে যোগদান করেন এবং সেখান থেকে ১৯০২ সালে বিশেষজ্ঞ স্টাফ হিসেবে নির্ধারিত হয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য জার্মানি চলে যান। সেখানে অবস্থানকালে তিনি জার্মানি প্রশিক্ষকদের ঔদ্ধত্য আচরনে অসন্তুষ্ট হন এবং তুর্কী জাতি সত্তাকে স্বীকৃতি দেয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

১৯০৫ সালে তিনি জার্মানির সামরিক উচ্চ শিক্ষা সমাপ্ত করে চাকরীতে যোগদান করেন একইসাথে তুর্কী জাতির মুক্তির ব্রত গ্রহণ করেন। তার সংঙ্গ দান করেন তার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব। তাদের এই এধরনের মত পোষন করার জন্য তারা গোয়েন্দা বিভাগের দৃষ্টিতে পড়েন এবং তাদেরকে কিছুদিন জেলও খাটতে হয়। তাদের এসব আচরনে সামরিক বাহিনী তাকে ও তার অনুসারী বন্ধুদেরকে রাজধানী থেকে দূরে সিরিয়ায় পঞ্চম সৈন্যবাহিনীতে স্থানান্তর করা হয়। সিরিয়ায় অবস্থান কালে তিনি শিক্ষিত তুর্কীদের মধ্যে তুর্কী জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগিয়ে তোলেন ১৯০৬ সালে তাদের নিয়ে “ওয়াতান” নামে একটি জাতীয়তাবাদী সংগঠন গড়ে তোলেন। আর অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এই সংগঠনের কার্যক্রম পার্শ্ববর্তী এলাকার শিক্ষিত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিতায় ১৯০৭ সালে তিনি ও তুরস্কের সংস্কারপন্থী সামরিক অফিসাররা মিলে গড়ে তোলেন “কমিউনিটি অব ইউনিয়ন এন্ড প্রোগ্রেস ” যা সংক্ষেপে কাপ (CUP) নামে পরিচিতি লাভ করে। অল্প সময়ের মধ্যে এতে তুর্কী সাম্রাজ্যের বহু সংস্কারপন্থী ও তরুন আন্দোলনকারী যোগদান করে ফলে তুর্কী সাম্রাজ্যকে একটি অসাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদী সাম্রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলার আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯০৮ সালে মেসিডোনিয়ায় তারা তিব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন ফলে তুরস্কের সুলতান ২য় আন্দুল হামিদ অনেকটা বাধ্য হয়ে কিছু সংস্কারনীতি গ্রহণ করেন এবং রাষ্ট্রীয় গোঁড়ামিপূর্ণ বেশ কয়েকটি আইন বাতিল করে তার স্থলে আধুনিকসব আইন প্রনয়ন করেন। এই সংস্কারের ফলে সুলতানের ক্ষমতা কিছুটা হ্রাস পায় এবং সীমিত পরিসরে প্রতিনিধিত্বমুলক শাসন ব্যাবস্থা গড়ে উঠে।

কিন্তু আল্পকাল পরেই এই বিপ্লবী দলসমুহ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক পক্ষ চেয়েছিল মুসলিম /অমুসলিম দের মধ্যে ঐক্য সাধন করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে। অপরদিকে কাপ(CUP) চেয়েছিল ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণ করে ঐক্যবদ্ধ তুর্কী গড়তে ফলে তাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এসময় মুস্তফা কামালের সুনাম বহুমাত্রায় বৃদ্ধি পেলে বেশ কয়েকজন তার প্রতিপক্ষ হিসেবে দাড়িয়ে যায়। তিনি আরও লক্ষ্য করেন যে সামরিক অফিসারররা ব্যাপক আকারে রাজনীতিতে যোগদান করছে। তিনি এটিকে একটি সামরিক বাহিনীর নেতিবাচক দিক হিসেবে নিলেন। তাই তিনি ঘোষনা দিলেন যে কোন সামরিক সদস্য একই সাথে সামরিক বাহিনী ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না এবং আরও বলেন যে কেউ যদি রাজনীতি তে যোগদান করতে চায় তাহলে তাকে সামরিক পদ হতে অব্যাহতি নিতে হবে। তিনি নিজেও সকল প্রকার রাজনীতি হতে অব্যাহতি নেন এবং সামরিক বাহিনীর কাজে মনোনিবেশ করেন। এরপর তিনি তুর্কী সামরিক বাহিনীর হয়ে ফ্রান্সে গমন করেন। সেখানে তিনি ফরাসি সামরিক বাহিনীর নানা অসংগতি তুলে ধরেন এবং উদারবাদী চিন্তা ও সামরিক সাফল্য দেখিয়ে বহু নবীন আর্মি অফিসারকে তার বক্ততে রূপান্তর করেন।

১৯১১ সালে লিভিয়ায় ইতালিয়ানদের আক্রমনের খবর শুনে তিনি সেখানে যান। কিন্তু অল্পকিছু দিন সেখানে অবস্থান করার পর তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন।ফলে সেখান থেকে বাধ্য হয়ে ফিরে আসতে হয়। বলে রাখা ভাল প্রথম বলকান যুদ্ধের সময় রাশিয়ার কাছে অটোমানরা পরাজিত হওয়ার দরুন অটোমানদের ইউরোপীয় ভূমি মনাস্তির, সালানিকাসহ বেশ কিছু অঞ্চল হারিয়ে ফেলে। ফলে এসব অঞ্চল হতে বহু শরনার্থী তুরস্কে চলে আসে এর মধ্যে মুস্তফা কামালের পরিবারও ছিল। ১৯১৬ সালে রাশিয়ানদের সাথে দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ দেখা দেয়। এসময় কামালের নেতৃত্বে অটোমানরা জয় লাভ করে তাদের হারানো অঞ্চল ফিরে পায়। তার নেতৃত্বে রাশিয়ারমত বড় শক্তির বিরুদ্ধে জয় লাভ করার জন্য তাকে পাশা হিসেবে উপাধি দেয়া হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া অক্ষ শক্তির পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অক্ষ শক্তি পরাজিত হয়। ফলে মিত্র শক্তি তথা বৃটেন জোট অটোমান সাম্রাজ্যকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দেয়। এসময় মুস্তফা কামাল আঙ্কারাভিত্তিক স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল তুর্কী ভাষাভাষী লোকদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে তুরস্ককে স্বাধীনতা দান করা এবং সকল বিদেশী শক্তির হাত থেকে নিজেদের সম্পুর্ন স্বাধীন রাখা। এসময় তুরস্কের শিক্ষিত যুবক শ্রেনী তাকে ব্যাপক সমর্থন দান করে। কিন্তু তার এই আন্দোলনকে তুরস্কের তৎকালিক বিলুপ্তপ্রায় সালতানাতের সুলতান সমর্থন দেন নি। ফলে তিনি নিজ উদ্যোগে তুরস্কের দক্ষিণ দিক হতে ইতালি কে পিছু হটতে বাধ্য করেন। তারপর একে একে আর্মেনিয়া ও গ্রীসকে তুরস্কের মাটি থেকে উৎখাত করেন। এর পর তিনি নজর দেন আঙ্কারার দিকে যেখানে গ্রীকরা ধংসযোগ্য চালাচ্ছিল। ফলে সেখান থেকে তিনি গ্রীকদেরও বিতারিত করেন। এরমধ্যে ১৯২১ সালে তিনি সামরিক বাহিনীর প্রাধান হিসেবে দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর তিনি নজর দেন ইস্তাম্বুলের দিকে যেখানে দখল করে ছিল ইংরেজ শক্তি। ফলে ইংরেজরা তার সাথে যুদ্ধে না জরিয়ে চুক্তিতে সম্মত হন। চুক্তিতে অনুযায়ী ব্রিটিশরা সুলতান সরকার ও মুস্তফা কামাল উভয়ের নিকট বার্তা প্রেরন করে যাতে উভয়ের সম্মেলিত অংশগ্রহণে সরকার গঠন করা যায়। কিন্তু ওদিকে আগেই মুস্তফা কামাল আঙ্কারায় জাতীয় সংসদে ঘোষনা দিয়ে সরকার গঠন করে। এই সংসদ সুলতান সরকার কে বিলুপ্ত হিসেবে ঘোষনা করে। এতে সুলতান ভয়ে পেয়ে ইংরেজদের সাথে চুক্তিতে না গিয়ে নিজের জীবন নিয়ে সুলতান পলায়ন করে। ফলে মুস্তফা কামাল এককভাবে ইংরেজদের সাথে চুক্তি করে ১৯২৩ সালে তুরস্কের স্বাধীনতা আদায় করে সেখানে নিজেকে প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন এবং সরকার গঠন করেন।

মুস্তফা কামাল ক্ষমতায় আরোহনের পর বেশ কিছু সংস্কার কাজ সাধন করে যার জন্য আজও সে ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে। যেমন -তুরস্ক মুসলিম প্রধান দেশ হওয়া সত্বেও মুস্তফা খলিফা কে পদচ্যুত করেন, দেশে সকল প্রকার ধর্মীয় আদালত ও স্কুল, সরকারি কর্মচারীদের মাথায় হিজাব পরা বন্ধ করে দেন এবং কামান আইন ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বিষয়ক মন্ত্রণালয় উঠিয়ে দেন। মদের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেন, শুক্রবারের বদলে রবিবারকে সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা করেন, এমনকি তিনি আযান ও আরবি ভাষায় না দিয়ে তুর্কি ভাষায় দেয়ার নিয়ম করেন। এক কথায় বলতে গেলে মুসলিম প্রধান একটি দেশের প্রেসিডেন্ট এবং নিজেও একজন মুসলিম হওয়া সত্বেও মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক তাঁর সমসাময়িক অন্য শাসকদের তুলনায় একটু বেশিই আধুনিকতার পথে হেঁটে ছিলেন।

তাঁর শাসনামলে তুরস্কে ব্যাপক শিল্পায়ন সাধিত হয় এবং তিনি ইউরোপীয় আদলে আইন প্রণয়ন করেন। ১৯২৬ সালে দেয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেন ‘ সভ্য দুনিয়া থেকে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে। তাই তাদের কে ধরা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই’। এর আট বছর পর তিনি তুরস্কের সবার জন্য নামের সাথে পদবী ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করেন। ঐ সময় তুরস্ক সরকার লিগ অব ন্যাশনে যোগ দেয় এবং স্বাক্ষরতার হার বাড়ায় ও নারীদের ভোটাধিকার দেয়। যদিও তুরস্কে তখন একদল কেন্দ্রীক সরকারই ছিল। এছাড়াও তিনি বিরোধী সকল পত্রিকা বন্ধ করে দেন, বামপন্থী সকল সংগঠন বন্ধ করে দেন এবং কুর্দিস্তানের স্বায়ত্বশাসিত করার সকল চেষ্টা মূলেই ধ্বংস করে দেন।

তার এইসব সংস্কারের জন্য গোড়া মুসলমানরা তাকে দেখে তুরস্কে ইসলামের শত্রু হিসেবে। অনেক আধুনিক ঐতিহাসিকও মত প্রকাশ করেন যে মুস্তফা কামাল ছিলেন ইংরেজদের এজেন্ট। মুস্তফার কাধে ভর করেই তারা বিশাল অটোমান সাম্রাজ্যকে ভাঙ্গতে সক্ষম হয় এবং তার স্থলে তাদের হুকুমের গোলাম হিসেবে তুরস্ককে প্রতিষ্ঠা করে। অপরদিকে তুরস্কের আধুনিক সংস্কারবাদী জনগন মনে করেন যে মুস্তফা কামাল তাদের দেশকে পুর্নাঙ্গ ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিকভাবে সুসংগঠিত একটি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে দিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। ১৯৩৮ সালের ১০ নভেম্বর নিঃসন্তান মুস্তফা কামাল ইস্তানবুলে তাঁর দলমাবাছে প্রাসাদের নিজ শয়নকক্ষে মৃত্যু বরণ করেন

তথ্যসূত্র

  • কামাল আতাতুর্ক -আব্দুল মতিন
  • http://itibritto.com/biography-of-kamal-ataturk/

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top